![এক্সিম-পদ্মা চুক্তি: আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের তাগিদ](uploads/2024/03/18/1710746869.exim-bank-padma-bank.jpg)
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণ বা মার্জারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই খবর প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট মহলে, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। একীভূত হওয়ার পর পদ্মা ব্যাংকের কর্মীদের কী হবে, যে দায়দেনা আছে তার দায়িত্ব কে নেবে, আমানতকারীদের স্বার্থ কেমন করে সংরক্ষণ করা হবে- এসব প্রশ্ন আলোচনায় উঠে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, একীভূত হওয়ার পর ভবিষ্যতে চলার কৌশল নির্ধারিত হবে গাইডলাইন বা দিকনির্দেশনার ভিত্তিতে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সবকিছু নির্ভর করবে দুই পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে। প্রতিষ্ঠান দুটির পরিচালনা পর্ষদ বসে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধান করবে। তবে বিশেষজ্ঞ সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন, একীভূত হওয়ার উদ্যোগটি ভালো। এর ফলে আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
ব্যাংক খাতের নানা সমস্যা সমাধানে গত মাসে একটি পথনকশা অনুমোদন করে বাংলাদশ ব্যাংক। তাতে একীভূত করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর মাত্র ১০ বছরের মাথায় দেশের চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ হারিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ডুবতে বসেছে। তাই এ ব্যাংকটিকে তুলনামূলক বহুগুণ শক্তিশালী দ্বিতীয় প্রজন্মের এক্সিম ব্যাংকে একীভূত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (১৮ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের উপস্থিতিতে আলোচিত দুই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা এ-বিষয়ক এক সমঝোতা স্মারক বা মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) স্বাক্ষর করবেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি এবং ডলার ও তারল্যসংকটসহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে সৃষ্ট নানা অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে এ দুই ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। তারা মনে করছেন, এর ফলে পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদের জন্য এক নতুন সুরক্ষা তৈরির সুযোগ পাওয়া গেল। স্বেচ্ছায় একীভূত হতে যাওয়া এ দুই ব্যাংক আমানতকারীর স্বার্থ সুরক্ষায় কী সমঝোতায় পৌঁছে, সবার নজর এখন সেদিকটায়। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ বর্ণিত বিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক মার্জার ও অ্যাকুইজিশনের প্রভিশনের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক জানিয়েছেন, একীভূত হওয়ার ফলে আমানতকারীদের শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত হবে।
তার পরও দেশে দুই বেসরকারি ব্যাংকের এই মার্জার বা একীভূতকরণ নিয়ে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি শরিয়াহভিত্তিক, অন্যটি প্রথাগত সুদভিত্তিক। ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসা এ দুই ভিন্নধারার দুটি ব্যাংক আমানতকারীদের কী ব্যাখ্যা দেবে, পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীরা কী ধরনের সুরক্ষা পাবে, পদ্মা ব্যাংকের সবার চাকরি সুরক্ষা হবে কি না- এসব নিয়ে খবরের কাগজ কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের সঙ্গে।
পদ্মা ব্যাংকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে আমানতকারীদের অর্থ আছে ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর বিতরণকৃত ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ঋণের ৬৩ দশমিক ৫০ শতাংশ বা ৩ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঝুঁকিভিত্তিক সূচক থেকে জানা গেছে, ব্যাংকটি পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা, আমানতকারীর অর্থের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ৪৬ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা, মোট সম্পদ ও দায় ৫৪ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ ১ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা বা মোট ঋণ ও বিনিয়োগের মাত্র ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘‘শুরু থেকেই পদ্মা ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ, ঋণ কেলেঙ্কারি এসব নিয়ে একটি ‘মন্দ নজির’ তৈরি করে আসছে। এ ধরনের ব্যাংক রাখারই দরকার নেই। যেভাবেই হোক এ ব্যাংকটি মার্জার হচ্ছে একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ হবে না, একটি অনির্দিষ্টকাল ধরে বিষয়টি ঝুলে থাকবে এটি তো ঠিক না। তাই এ উদ্যোগ সময়োপযোগী। আরও আগে হলে ভালো হতো।”
ড. সালেহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘ব্যাংক দুটির একীভূতকরণে দুটি জিনিস দেখা দরকার। একটি আইনগত বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি মার্জার অ্যাকুইজেশনের গাইডলাইন দেবে। আর আইনের ব্যাপারটি হলো; ব্যাংক কোম্পানি আইন। পরিচালনা পর্ষদের আকার কী হবে, কারা থাকবে, ব্যাংকটি মন্দ হয়ে পড়ার কারণ যেসব পরিচালক, তারা আবারও থাকবেন কি না, আমানতকারীর স্বার্থ কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে- এগুলো দেখতে হবে। আমার মতে, যাদের কারণে ব্যাংকটি খারাপ হয়েছে, তাদের রাখা ঠিক হবে না। আরেকটি বিষয় হলো আর্থিক। কী পরিমাণ আমানত, কত ঋণ ও বিনিয়োগ, কত খেলাপি এবং কত সম্পদ কী অবস্থায় আছে, সেগুলো নিয়ম ও বিধি অনুসরণ করে (ডিউ ডিলিজেন্স) পরবর্তী কার্যক্রম পরিপালন করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে অডিট করতে হবে।’
সাবেক এই গভর্নর মনে করেন, ‘আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সেটির জন্য একটি স্কিম করতে হবে। ছোট আমানতকারীদের একসঙ্গে সবটুকু অর্থ দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিস্তিতেও দেওয়া যেতে পারে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনে সুনির্দিষ্ট থাকতে হবে। যাতে করে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। এক কথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকনির্দেশনায় মার্জারের সুচারু নিষ্পত্তি এবং ভবিষ্যতের পথনকশা থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যে বিষয়টি ভেবেচিন্তে করতে হবে তা হলো চাকরির সুরক্ষা। গুড ট্র্যাক রেকর্ড আছে এবং ব্যাংকটির আর্থিক খারাপ পরিণতির জন্য দায় নেই- এমন কারও চাকরি যেন না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটিও ভালো।’
সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ও বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত খবরের কাগজকে বলেন, ‘যখন কোনো প্রতিষ্ঠান মার্জার করা হয়, তখন কিছু শর্ত থাকে। কর্মী ছাঁটাই করা যাবে না- নিশ্চয়ই এ বিষয়ে এমন কিছু শর্ত থাকবে। কারও চাকরি থাকবে কি থাকবে না, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার ওপর নির্ভর করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজেরা বসে ঠিক করবে। এখনো বিশদভাবে উপায় খুঁজে বের করায় কৌশল নির্ধারণ করা হয়নি। আমি মনে করি, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দুই ব্যাংক একীভূত করা হয়েছে। তাদের (আমানতকারীদের) ভয়ের কোনো কারণ দেখছি না। পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্যই এটি করা হলো। কাজেই আমানতকারীদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
একীভূত ব্যাংকের এমডি কে হবেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দুই ব্যাংক বসে ঠিক করবে। আগে থেকে কিছু বলে বিভ্রান্তি ছাড়ানো ঠিক হবে না।’ পদ্মা ব্যাংকের দায় কে নেবে- এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নেবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হলে তিনটি অপশন থাকে। প্রথমত, ব্যাংকটিকে মরতে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখা। তৃতীয়ত, ব্যাংকটিকে কোনোভাবে মার্জ করে পুনরুদ্ধার করা। পদ্মা ব্যাংককে চেষ্টা করা হয়েছে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু সফল হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবে একীভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আশা করছি, একীভূতের ফলে ইতিবাচক ফল আসবে।’
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সিইও এবং ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, ‘একীভূত করার ফলে পদ্মা ব্যাংকের কিছু লোক চাকরি হারাবে। বিশেষ করে যারা প্রধান কাযালয়ে কর্মরত। আর যদি শাখা বন্ধ হয় কিছু লোককে বিদায় নিতে হবে। এটি মার্জার বা একীভূত হওয়ার নিয়মের কথা। তবে কীভাবে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হবে, তা নির্ভর করবে দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তের ওপর।’
তিনি বলেন, ‘যে ব্যাংকটি একীভূত হলো তাদের আমানতকারীদের প্রত্যেককে প্রাথমিকভাবে ২ লাখ টাকা করে দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে। এই টাকা এক্সিম ব্যাংক দেওয়ার কথা। না দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারবে।’
ব্যাংকের নাম পরিবর্তন হবে কি- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত নেবে দুই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। তবে ব্যাংকের এমডি ও সিইও একজনই থাকবেন। কে এমডি থাকবেন, সেটিও সিদ্ধান্ত নেবে দুই ব্যাংকের পর্ষদ। আমি মনে করি, মার্জারের উদ্যোগ ভালো। কেননা আমানতকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।’
গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঘটনা ইতিবাচক। ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ার পেছনে বাস্তব কারণ ছিল। দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চতুর্থ প্রজন্মের এতগুলো ব্যাংকের প্রয়োজন ছিল কি না, সেটি একটি প্রশ্ন। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোয় শৃঙ্খলার অভাব ছিল দৃশ্যমান। যেসব কারণে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়েছে, সেসব কারণ আমলে নেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটি না করে শুধু একীভূত করা হলে কার্যকর কিছু হবে না।’