![মানিকগঞ্জ পৌরসভার ভাগাড়ের বর্জ্যে কৃষি কাজ ব্যাহত](uploads/2024/03/24/1711254683.Manikganj-municipality-dump.jpg)
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দিঘী ইউনিয়ন। এই ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটবাউর গ্রামের রহম আলী কৃষি কাজ করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরোনো এই কৃষকের দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে। কিন্তু একসময় তিনি সচ্ছল ছিলেন। নিজের জমিতে ধানের পাশাপাশি সবজির আবাদ করে ভালোই চলছিল তার। কিন্তু ২০১২ সালে তার জমির পাশেই গড়ে ওঠে মানিকগঞ্জ পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশন। সেখানে ফেলা ময়লার কারণে তিনি এখন ঠিকমতো চাষাবাদ করতে পারেন না। কী করবেন তাও বুঝে উঠতে পারছেন না।
প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে বলেন, ‘এই ময়লার ভাগাড় হওয়ার পরও আমি এখানে নানা সবজিসহ ধানের আবাদ করতাম। কিন্তু আমার জমির ওপর একটু একটু করে ময়লা ফেলার কারণে আমি আট বছর ধরে কিছুই আবাদ করতে পারি না। আমি গরিব মানুষ। এখন কী করব। আমার জায়গা আমি ফেরত চাই।’
রহম আলী একা নন। তার মতো একই অবস্থা ওই এলাকার শতাধিক বিঘা জমির কৃষকের। একই এলাকার কৃষক হালিম বলেন, ‘আমার জমি ঠিক ভাগাড়ের পাশে। এখান থেকে সাত-আট প্লট দূরের জমিতে যারা আবাদ করেন তাদের আমার চেয়ে অনেক বেশি ধান হয়। আমি যেখানে ১৬ থেকে ১৭ মণ ধান পাই, ঠিক একই পরিমাণ জমিতে তারা পান ২৭ মণ।’ শ্রমিকরা তার জমিতে কাজ করতে চান না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘মেডিকেলের বিভিন্ন ময়লা, সুঁই হাতে বিঁধে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমার মতো কৃষকের কথা চিন্তা করে হলেও পৌরসভার পক্ষ থেকে জায়গাটি সংস্কার করা উচিত। তাহলে আমরা নির্বিঘ্নে কৃষি কাজ করতে পারব।’
মূলত পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনের কারণে ওই এলাকার কৃষকরা ফসল ফলাতে পারছেন না। যারা আবাদ করছেন তাদের উৎপাদন কমেছে উদ্বেগজনক হারে। ময়লার দুর্গন্ধে ইউনিয়ন পরিষদ ও পার্শ্ববর্তী স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। হাসপাতালের বর্জ্য ফেলার কারণে সেখানে থেকে বিভিন্ন রোগ ছড়ানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভুক্তভোগী কৃষকরা গত বছরের ৩১ আগস্ট জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। শিগগিরই পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনটির সীমানা প্রাচীর তৈরি করে বাইরের বর্জ্যগুলো সেখানে স্থানান্তর করার দাবি ভুক্তভোগী কৃষক ও এলাকাবাসীর। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, শিগগিরই সেখানে উন্নত মানের ডাম্পিং স্টেশন তৈরি করা হবে। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, জমি কিনে ময়লার ভাগাড়টি সড়ানোর আশ্বাস।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনের নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও সেখানে ময়লা না ফেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আশপাশের কৃষিজমিতে ময়লা ফেলছেন। ময়লা ফেলতে ফেলতে তা এখন ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ছুঁইছুঁই। পাশের কৃষিজমিতেও স্তূপ করে রাখা হয়েছে বর্জ্যগুলো। হাসপাতালের ওষুধের কাচের বোতল, টিউব, সুঁই, সিরিঞ্জ, ব্লেড, পলিথিনসহ বাসা-বাড়ির সব বর্জ্যই সেখানে বিদ্যমান। ২০১২ সালে শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে সদরের দিঘী ইউনিয়নের ভাটবাউর এলাকায় এই ডাম্পিং স্টেশনটি চালু করা হয়।
ওই ইউনিয়নের ভাটবাউর গ্রামের আবদুল সামাদ মাস্টার জানান, ডাম্পিং স্টেশন হলে পরিবেশ দূষিত হবে- এই ভেবে তখন আমরা বাধা দেই। কিন্তু আমাদের কোনো কথা না শুনেই তারা এখানে আড়াই একরের বেশি জায়গার ওপর এটি প্রতিষ্ঠা করে। তখন আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, এখান থেকে বিদ্যুৎ, গ্যাস উৎপাদন হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা আমাদের দেওয়া হবে। কিন্তু এখন নির্ধারিত জায়গার পাশাপাশি আমাদের জমিতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।
ওই এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জানান, এখানকার গজারিয়া বিলটি একসময় শস্য উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু ডাম্পিং স্টেশন হওয়ার কয়েক বছর পর থেকে তারা সঠিক সময়ে কোনো ফসল চাষাবাদ করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট জায়গায় না ফেলায় এসব ময়লা বৃষ্টি ও বাতাসের মাধ্যমে আমাদের জমিতে গিয়ে পড়ে। এতে আমাদের জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এসব আবর্জনা পরিষ্কারের জন্যও কোনো শ্রমিকও পাওয়া যায় না। যারা একবার কাজে আসেন, তারাও পরদিন কাজ ছেড়ে চলে যেতে চান। প্রায় ১০০ বিঘার মতো জমি এই ডাম্পিং স্টেশনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু তাহের লিটন বলেন, ‘গরমের সময় ময়লার ভাগাড় থেকে প্রচুর দুর্গন্ধ ছড়ায়। এই গন্ধে আমাদের গ্রামের মানুষের অনেক সমস্যা হয়। পাশেই আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুর্গন্ধের কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয়। আমাদের একটাই দাবি, এই ভাগাড়কে দ্রুত সংস্কার করা হোক।’
মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার কাজী এ কে এম রাসেল বলেন, ‘আমাদের বাসাবাড়ি কিংবা ক্লিনিক্যাল বর্জ্যগুলো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না হলে নানা রকমের রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বায়ু, মাটি, পানিদূষণসহ পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। আর নিডেল সুঁজের মতো কিছু ক্লিনিক্যাল বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা না হলে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং এইচআইভির মতো রোগ বৃদ্ধি পাবে। এসব ক্লিনিক্যাল বর্জ্যগুলো কোনোভাবেই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা যাবে না।’
মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র রমজান আলী বলেন, ‘আমি ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওই ডাম্পিং স্টেশনে সরেজমিন ঘুরে দেখব। নির্ধারিত জায়গার বাইরে যেসব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়েছে সেগুলো অপসারণ করব। নির্ধারিত জায়গায় বর্জ্যগুলো ফেলা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য একজন লোক রাখা হবে। শিগগিরই সেখানে উন্নত মানের ডাম্পিং স্টেশন তৈরি করা হবে।’
জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার খবরের কাগজকে জানান, ডাম্পিং স্টেশনের সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করছি। এটির জন্য জমি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিগগিরই এই সমস্যার সুরাহা করতে চেষ্টা করব।