ফেনীর এক সিএনজি ফিলিং স্টেশনে সম্প্রতি একটি অটোরিকশাকে গ্যাস দিচ্ছিলেন সাইদুল ও রনি। হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাইদুল। গুরুতর আহত হন রনি।
ফেনীতে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে গোটা দেশে। গাড়িতে ব্যবহৃত সিলিন্ডারকে ‘চলন্ত বোমা’র সঙ্গে তুলনা করা যায়। কারণ এটি বিস্ফোরিত হলে বোমার মতোই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। আর পেটে এমন ‘চলন্ত বোমা’ নিয়ে সারা দেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, অটোরিকশাসহ ৫ লাখ ৯৩ হাজার যানবাহন। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে দেশে ১২৫টি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) হিসাব অনুযায়ী দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা ৫ লাখ ৯৩ হাজারের মতো। অনেক গাড়িতে দুই বা ততধিক সিলিন্ডার থাকে। সেই হিসাবে সিলিন্ডারের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
এ প্রসঙ্গে আরপিজিসিএলের ব্যবস্থাপক (সিএনজি) প্রকৌশলী মো. মনোয়ারুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘যদি কার্বন স্টিলের সিলিন্ডার হয়, তাহলে সেটি ২০ বছর ব্যবহার করা যায়। ব্যবহার না করে ২০ বছর ফেলে রাখলেও সেটি মেয়াদ ২০ বছর। উৎপাদনের তারিখ থেকে ২০ বছর। এই ২০ বছরর মধ্যে ৫ বছর অন্তর অন্তর হাইড্রোস্ট্যাটিক টেস্ট করাতে হবে। টেস্ট করার সময় উচ্চমাত্রায় সিলিন্ডারে পানির প্রেশার দেওয়া হয়। প্রেশার দিলে সিলিন্ডার প্রসারিত হয়। প্রেশার সরিয়ে নিলে সিলিন্ডার আগের অবস্থায় চলে আসে। যদি এই প্রসারণ ৫ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে সেই সিলিন্ডার ব্যবহার উপযোগী না। নতুন সিলিন্ডার লাগাতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী মনোয়ারুল বলেন, ‘সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের জন্য অথরাইজড প্রতিষ্ঠান আছে। এটি বিস্ফোরক পরিদপ্তরও দেখভাল করে।’
বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর জানান, বাজারে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারের সংখ্যা দুই লাখ। এসব সিলিন্ডারের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে।
ফারহান নূর আরও জানান, যানবাহনে গ্যাস দেওয়ার সময় ফিটনেস সনদ দেখার ক্ষমতা আইনে ফিলিং স্টেশনগুলোকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানে সিএনজি কনভার্সন বেআইনি বলেও জানান তিনি।
সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের ভুয়া সনদে ফিটনেস নবায়ন!
ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের ফিটনেস দেখে থাকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। কিন্তু ফিটনেস নবায়ন করতে সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের সার্টিফিকেট লাগে না। অনেক সময় ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া বিআরটিএ কর্মকর্তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন।
বিআরটিএর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, যানবাহনের ফিটনেস নবায়ন করতে ছয় ধরনের কাগজ লাগে। তবে সেই ছয় ধরনের কাগজের মধ্যে নেই সিএনজি সিলিন্ডার রিটেস্টিংয়ের সনদ।
যদিও ২০১৬ সালের ২৮ জুন একটি সার্কুলারে বিআরটিএ জানায়, আরপিজিসিএল অনুমোদিত সিএনজি সিলিন্ডার টেস্টিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে তা ব্যবহারের উপযুক্ত কি না বা মেয়াদ পেরিয়ে গেছে কি না, বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া আবশ্যক। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, বিআরটিএ কর্মকর্তা এই সার্কুলারের নির্দেশ না মেনে ফিটনেস সনদ দিয়ে দেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রয়েছে তদারকি ও জনসচেতনতার অভাব
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআরটিএ ও পুলিশের তদারকির অভাব এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মাঝে মাঝে যানবাহনে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া রয়েছে ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা। এ কারণে গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার এক ধরনের আতঙ্কে রূপ নিয়েছে।
আরপিজিসিএলের সিএনজি ডিভিশনের উপমহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিষয়টি দেখতে নিয়মিত পরিদর্শক দল পরিদর্শন করে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বাড়াতে মাঝে মাঝেই আমরা গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করি।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, যানবাহনে ব্যবহৃত সিলিন্ডারে গ্যাসের চাপ ৩৫০০ পিএসআই থাকে। অর্থাৎ প্রতি ইঞ্চিতে সাড়ে তিন হাজার পাউন্ড ওজনের সমান চাপ। এটা যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে সেটা ভয়াবহ হবেই।