![নিবন্ধন নেই, ভ্যাটও নেই](uploads/2024/04/20/1713600947.vat.jpg)
এবারে ঈদ ও পয়লা বৈশাখে রমরমা বাণিজ্য করলেও বড় মাপের অর্ধেকের বেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান একটি টাকার ভ্যাট জমা দেয়নি। এসব প্রতিষ্ঠান এখনো অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনই করেনি। তাই ভ্যাট জমা না দিলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নজরে আসছে না। ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিপ্তরের তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব জানা গেছে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, রমরমা বাণিজ্য করেও বছরের পর বছর ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে চলেছে এমন প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে এবার রমজানের শুরু থেকেই মাঠে নেমেছেন ভ্যাট গোয়েন্দারা, যা ঈদুল আজহা পর্যন্ত চলবে।
আদায় করেও একটি টাকার ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি, হিসাবের চেয়ে কম পরিশোধ করেছে এবং অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন করেনি এমন সব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে ভ্যাট গোয়েন্দারা বিশেষ নজরদারি করছেন। পর্যায়ক্রমে রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের নামিদামি বিপণিবিতানের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট পরিশোধের তথ্য যাচাই করা হবে। এ কাজে ভ্যাট গোয়েন্দারা ভ্যাটের অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে তথ্যও নেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, যমুনা ফিউচার পার্ক, মেট্রো, রাপা, রাজলক্ষ্মী, মিরপুর শপিংমল, অরচার্ড পয়েন্ট, মৌচাক মার্কেট, সীমান্ত স্কয়ার, নিউমার্কেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিপিংমলে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ভ্যাট গোয়েন্দারা বিনা নোটিশে হাজির হয়েছেন। ভ্যাট পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখেছেন। এসব শপিংমলের অর্ধেকের বেশি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনই করেনি। রাজধানীর গুলশান-২-এ অবস্থিত পিংক সিটি শপিংমলে অভিযান চালিয়ে দেখা যায়, দুই শতাধিক দোকান ভ্যাট প্রদানে সক্ষম হলেও মাত্র ৬৪টি দোকান ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর গ্রহণ করেছে। এ শপিংমলের মাত্র ৪০টি প্রতিষ্ঠান সঠিক হিসাবে ভ্যাট পরিশোধ করলেও বাকিরা মিথ্যা তথ্যে পাওনা ভ্যাটের অতি সামান্য পরিশোধ করেছে। এ শপিংমলের বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৪১ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পাওয়া যায়। এসব শপিংমলের বাইরেও বড় বড় বিপণিবিতানেও ভ্যাট গোয়েন্দারা হাজির হয়ে ভ্যাট পরিশোধের তথ্য খতিয়ে দেখছেন।
ভ্যাট গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ভ্যাট নিবন্ধন না করলেও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সাধারণ ক্রেতার কাছ থেকে ঠিকই পণ্যের মূল্যের সঙ্গে হিসাব কষে কড়ায়-গণ্ডায় ভ্যাট আদায় করেছে। আদায় করা ভ্যাটের সবটা নিজের পকেটে রেখে দিয়েছে। ভ্যাট যোগ করায় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্রেতা না জেনেই পণ্যের মূল্য হিসেবে ভ্যাট পরিশোধ করেছেন। ভ্যাট আদায় করলেও ক্রেতাকে ভ্যাট পরিশোধের চালান দেওয়া হয়নি। বড় বড় বিপণিবিতানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, নিরাপত্তা, মানসম্মত পণ্য বিক্রিসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাইরের বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দাম রাখা হয়।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এবারে রমজানের শুরু থেকেই ভ্যাট গোয়েন্দারা পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়েছেন। সরেজমিনে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বেচাকেনার তথ্য সংগ্রহের পর ভ্যাট পরিশোধের তথ্য জানতে চেয়েছেন। কী দামে পণ্য কিনেছে, কী দামে বিক্রি করেছে এবং কতটা ভ্যাট পরিশোধ করেছে এসব সংগ্রহ করেছেন। অনেক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জাল বা ভুয়া ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর টাঙিয়ে রেখেছে। ভ্যাট গোয়েন্দারা অনলাইনে খতিয়ে দেখে ভ্যাট নিবন্ধনের জাল সনদ টাঙিয়ে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ভ্যাট আইন অনুসারে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অনলাইনে নিবন্ধিত ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর বাধ্যতামূলকভাবে প্রদর্শন করে রাখতে হবে।
গত বুধবার পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে ভ্যাট গোয়েন্দারা প্রতিবেদনে বলেছেন, গড়ে বড় মাপের ৬৫ শতাংশ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এখনো অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনই করেনি। এই ৬৫ শতাংশের মধ্যে ৩২ শতাংশ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান শোরুমে নকল ভ্যাট নিবন্ধনের জাল সনদপত্র টাঙিয়ে রেখেছে। অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন করেছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই হিসাবের চেয়ে কম ভ্যাট পরিশোধ করেছে।
ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুর রউফ খবরের কাগজকে বলেন, অতীতে দেখা গিয়েছে ঈদ, পয়লা বৈশাখে ভালো বেচাকেনা করেও ঠিকমতো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। এবারে রমজানের শুরু থেকেই রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরের বড় বড় শপিংমল এবং ব্র্যান্ডের দোকানে ঈদ ও পয়লা বৈশাখে কেমন বেচাকেনা হয়েছে তার খোঁজ রাখা হয়। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভালোই বেচাকেনা হয়েছে। অথচ ভালো বেচাকেনা করেও অনেকে ঠিকমতো ভ্যাট পরিশোধ করছে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভ্যাট পরিশোধ তো দূরের কথা, অনেকে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধনই করেনি।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা বছরের মধ্যে দুই ঈদ ও পয়লা বৈশাখে ভালো বেচাকেনা হয়। আমরা যারা সৎ ব্যবসায়ী তারা তো হিসাবমতো ভ্যাট পরিশোধ করছেন। অথচ অনেকে আছেন বিভিন্ন কৌশলে ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন। এদের আইনের আওতায় আনা উচিত। এনবিআর থেকে আরও নজরদারি বাড়ানো উচিত।’