গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব (রিটার্ন) নির্বাচন কমিশনে জমা দেননি শতাধিক প্রার্থী ও ৯টি রাজনৈতিক দল। চট্টগ্রামসহ তিন জেলার প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব এখনো পুরোপুরি বুঝে পাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে দুর্বলতার কারণেই বন্ধ হচ্ছে না এসব অনিয়ম।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে, ভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশের পরবর্তী এক মাসের (৩০ দিন) মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব প্রার্থী এবং তিন মাসের (৯০ দিন) মধ্যে সব দলের ইসিতে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব বিবরণীর সত্যায়িত কপি দাখিল করা বাধ্যতামূলক। সংসদ নির্বাচনের পর সংস্থাটির নির্বাচন পরিচালনা শাখা থেকে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন আদেশ জারি করা হয়। তাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সব প্রার্থী ও দলকে নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আইন অনুযায়ী, এই দলগুলোর নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ৭ এপ্রিল। আর প্রার্থীদের হিসাব জমা দেওয়ার শেষ সময় ছিল গত ৭ ফেব্রুয়ারি। এবারের সংসদ নির্বাচনে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেয় ২৮টি রাজনৈতিক দল।
সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন আসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে খবরের কাগজের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরপিও আইনে উল্লিখিত ভোট-পরবর্তী নির্ধারিত সময়ে ২৮টি দলের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব (রিটার্ন) ইসিতে জমা দিয়েছে মোট ১৯টি রাজনৈতিক দল। তাদের মধ্যে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সংস্থার পক্ষ থেকে পাঠানো চিঠির পর ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ রিটার্ন জমা দিয়েছে চারটি দল। এখনো ব্যয়ের হিসাব জমা দেয়নি ৯টি দল। তারা হলো বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। তাদের মধ্যে বাড়তি এক মাস সময় চেয়ে ইসিতে আবেদন করেছে দুটি দল- জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট।
সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের বিপরীতে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট ১ হাজার ৯৭৭ জন। তাদের মধ্য থেকে ভোটের পর নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা দিয়েছেন ১ হাজার ৭৪৮ প্রার্থী। অন্যদিকে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর চার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা দেননি এক শর বেশি প্রার্থী। এ ছাড়া তিন জেলার (চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ ও নাটোর) প্রার্থীদের ব্যয়ের হিসাব এখনো পুরোপুরি বুঝে পাননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এবার প্রার্থীদের জন্য ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ব্যয় ১০ টাকা এবং ভোটার সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, একজন প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনি ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দলকে প্রার্থী অনুপাতে ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন- কোনো দলের প্রার্থী ২০০ জনের বেশি হলে সর্বোচ্চ ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, প্রার্থীর সংখ্যা ১০০ জনের বেশি, তবে ২০০ জনের কম হলে ব্যয়সীমা ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া কোনো দলের প্রার্থীর সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ হলে সেই দল দেড় কোটি টাকা এবং প্রার্থীর সংখ্যা ৫০ জনের কম হলে তাদের সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ৭৫ লাখ টাকা।
বিগত দিনে আইন লঙ্ঘনের শাস্তি ও ব্যবস্থা
আইনে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনি ব্যয়ের বিবরণী জমা না দিলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি বা জরিমানার বিধান রয়েছে। আর দলের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি নিবন্ধন বাতিলের বিধান রয়েছে।
বিগত বেশ কয়েকটি সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনি ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা না দিয়ে আইন লঙ্ঘনকারী অর্ধশতাধিক প্রার্থীর মধ্যে অন্তত ২৩ জনের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছিল। যেটি ছিল সংসদ ভোটের পর নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলার প্রথম ঘটনা।
তার আগে অষ্টম সংসদে প্রায় দুই হাজার প্রার্থীর মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রার্থীই রিটার্ন দাখিল না করে পার পেয়ে যান।
অন্যদিকে দলের ক্ষেত্রে নির্বাচনি ব্যয় বিবরণী জমা না দেওয়ার কারণে এ পর্যন্ত কোনো দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের নজির নেই। তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ইসি মামলা করেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন নির্বাচনে বেশির ভাগ দল ও প্রার্থীই সময়মতো তাদের ব্যয়ের রিটার্ন দাখিল না করে পার পেয়ে গেছেন। একই সঙ্গে প্রকৃত নির্বাচনি ব্যয়ের তথ্য তারা কৌশলে গোপন করেন।
অনিয়ম নিয়ে টিআইবির বিশ্লেষণ
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটে অংশ নেন ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মোট ১ হাজার ৭৩৩ প্রার্থী। ওই নির্বাচনের পর ২১টি আসনের ৪৫ জন প্রার্থীর নির্বাচনি ব্যয়ের রিটার্ন নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা টিআইবি।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ব্যয়ের রিটার্ন জমা দেওয়া এসব প্রার্থীর মধ্যে ৪০ জন প্রার্থী ব্যয়ের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এই প্রার্থীদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাবের তথ্য গবেষণা করে টিআইবি দেখতে পায়, বেশির ভাগ প্রার্থীই তাদের প্রকৃত ব্যয়ের তথ্য গোপন করেছেন। কোনো প্রার্থীই রিটার্নে ২৫ লাখ টাকার বেশি ব্যয় দেখাননি, বরং অনেক কম দেখিয়েছেন। ৪০ জনের মধ্যে একজন সর্বনিম্ন ব্যয় দেখিয়েছেন ৭১ হাজার ৩০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ব্যয় দেখিয়েছেন একজন, ২৫ লাখ টাকা।
অথচ মাঠের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ প্রার্থীই প্রচারের জন্য অনুমোদিত সময়ে নির্ধারিত ব্যয়সীমার অনেক বেশি ব্যয় করেছেন।
এবারের সংসদ নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ছাড়াও স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৪৩৭ জন। সব মিলিয়ে ৩০০ আসনে ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১ হাজার ৯৭৭ জন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী দেয় জাতীয় পার্টি ২৬৪ জন, দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ ২৬৫ জন। দল দুটি সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয় করার সুযোগ পায়। এ ছাড়া তৃণমূল বিএনপি ১৩৫ জন ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ১২২ জন করে প্রার্থী দিয়েছিল। দল দুটি সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা করে ব্যয় করার সুযোগ পায়।
ভোটে অংশ নিলেই ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে: এম সাখাওয়াত হোসেন
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দিলে প্রার্থীদের জন্য জেল-জরিমানা আর দলের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের যে বিধান রয়েছে, তা কি কখনো কার্যকর করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দলের ক্ষেত্রে না হলেও নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা না দেওয়ায় সংখ্যা মনে নেই, বেশ কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের সময় মামলা করা হয়েছিল। অনেকে জেলেও গিয়েছিলেন। এ ছাড়া কয়েকজনকে জরিমানা বা অর্থদণ্ড করা হয়। অনেক প্রার্থী মনে করেন ভোটে হেরে গেলে আবার রিটার্ন কেন দিতে হবে! আইনে আছে, হারুক বা জিতুক প্রার্থী হলে তাকে নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দিতেই হবে। তবে দলের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নিতে হয়নি কারণ সব দলই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হিসাব দিয়েছিল, যদিও দল-প্রার্থী কারোর জমা দেওয়া হিসাবই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নানা কৌশলে তারা নির্ধারিত অঙ্কের মধ্যেই ব্যয়ের হিসাব দিয়ে থাকেন। নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এই লুকোচুরি বন্ধে এ আইন করার পরামর্শ আমি দিয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে সে ব্যাপারে কাউকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।’
লুকোচুরি দৃশ্যমান, আইন প্রয়োগে ব্যর্থ কর্তৃপক্ষ: ড. ইফতেখারুজ্জামান
নির্বাচনের প্রকৃত ব্যয় লুকানো, সময়মতো রিটার্ন দাখিল না করা- ঘটনাগুলো সবারই জানা, দৃশ্যমান। এসব অনিয়ম বন্ধের এখতিয়ার কমিশনের। আইনে সুস্পষ্টভাবে তা উল্লেখও করা আছে। তারপরও দু-একটা ব্যতিক্রম পদক্ষেপ ছাড়া আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের কোনো শাস্তি না হওয়ায় এ ধরনের প্রতারণাকে দল বা প্রার্থীদের বেশির ভাগই স্বাভাবিক, অলিখিত এখতিয়ার মনে করেন। ভাবখানা এমন যে তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব তারা কতখানি করেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
নির্বাচনকে ঘিরে ভোটের মাঠে যে অর্থের খেলা হয় তার খুব সামান্যই তাদের ব্যয় বিবরণীতে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ দেখা যায় না। রাজনৈতিক শক্তির অনৈতিক প্রভাবে আইনি ব্যবস্থা কার্যকরে সংশ্লিষ্ট সংস্থার উদাসীনতা ও সক্ষমতার ঘাটতিতে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। নির্বাচনে অনিয়মের বেড়াজাল কিন্তু তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, অর্থ ও পেশিশক্তির ধারাবাহিক প্রভাবে। এসবের প্রতিকার ইসির একার পক্ষে করা সম্ভব নয় মনে করি। একমাত্র পারবে রাজনৈতিক দলগুলো, যদি তারা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিকারের উপায় খোঁজে। অনিয়ম রোধে নৈতিক ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিতে কীভাবে ফিরে আসা যার তার নীতি-কৌশল দলগুলোকেই নির্ধারণ করতে হবে।
এ বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানিয়েছেন, ‘আইনে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রার্থী ও দলগুলোর কাছ থেকে তাদের নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব জমা নিয়ে সেগুলো ইসিতে পাঠাতে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে কয়েক দফা চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত বেশির ভাগ প্রার্থী ও দল হিসাব জমা দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী আবেদন সাপেক্ষে হিসাব দিতে ব্যর্থ দলের জন্য ১৫ দিন জরিমানা ছাড়া এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানাসহ সর্বোচ্চ এক মাস বর্ধিত সময় দেওয়া যাবে। ওই সময়ের মধ্যে না দিলে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার বিধান রয়েছে। বর্ধিত সময়সীমা শেষ হওয়ায় অভিযুক্ত দল ও প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’