![দাম বাড়বে শতাধিক পণ্যের](uploads/2024/05/18/Price_Hike-1716016885.jpg)
প্রস্তাবিত বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সুপারিশে শতাধিক পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি কমানো ও প্রত্যাহার এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাজেট ঘোষণার পরই এসব পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দাতা সংস্থার চাপে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ১ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতিবারের চেয়ে আগামী অর্থবছরে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ভ্যাট আদায় করতে হবে এনবিআরকে।
বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে গিয়ে এনবিআরকে অনেক পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়াতে হচ্ছে। ভ্যাটের হার বাড়ানোর জন্য নতুনভাবে ভ্যাট আরোপ করতে হচ্ছে, ভ্যাট অব্যাহতি বা প্রত্যাহার ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হচ্ছে। কোন কোন পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি ও প্রত্যাহার এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে তার চূড়ান্ত তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এরই মধ্যে এ তালিকায় সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে এমন অনেক পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তালিকায় সাবান, শ্যাম্পু, অনেক গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) থাকার কথাও সূত্র জানিয়েছে।
ওষুধের অনেক কাঁচামালও রাখা হয়েছে এ তালিকায়। এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে ওষুধ উৎপাদন করলে তার খরচ বাড়বে। ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও ওই সব ওষুধ আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হবে। অন্যদিকে শিল্পে ব্যবহৃত অনেক রাসায়নিকও আছে এখানে। মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বাড়ানো হচ্ছে। লিফট, মোবাইল ফোনসেট ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত গাড়ি, আমদানি করা মোটরসাইকেল, আমদানি করা মোবাইল হ্যান্ডসেট, বিদেশি বিস্কুট, চকলেট, আমদানি করা জুয়েলারি ও প্রসাধনীরও দাম বাড়ানো হচ্ছে।
বাজেট প্রস্তাব ঘোষণার পরই এসব পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বেড়ে যাবে। আর এতে পণ্য কিনতে হলে বেশি দাম দিতে হবে।
প্রযুক্তি খাতে ভ্যাট অব্যাহতি কমানো ও প্রত্যাহারে কাজ করছে এনবিআর। এর মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে ভ্যাট অব্যাহতি কমাতে হিসাব চলছে। আর এতে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের খরচ বাড়বে। দেশি মোবাইল হ্যান্ডসেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড ও এ জাতীয় পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাড়তি ভ্যাট আদায় করতে হলে এনবিআরকে অবশ্যই বিভিন্ন খাতে ভ্যাটের হার বাড়াতে হবে এমন মত জানিয়ে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘ভ্যাট যোগ করে পণ্যের দাম হিসেবে আদায় করা হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ না জেনেই তা পণ্যের দাম হিসেবে পরিশোধ করে থাকে। ভ্যাট রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে নিরাপদ হাতিয়ার। রাজস্ব আদায়ে চাপ থাকলেই এনবিআর সহজ পথ হিসেবে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে আদায় করে।’
অর্থনীতির এ বিশ্লেষক বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়াতে হলে পণ্য মূল্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়াতে হবে। ভ্যাটের হার বাড়াতে হলে নতুনভাবে ভ্যাট আরোপ করতে হবে। আবার ভ্যাট অব্যাহতি কমালে, প্রত্যাহার করলে এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপ করলেও ভ্যাটের হার বাড়বে। যেসব পণ্যের ওপর ভ্যাটের হার বাড়ানো হবে তার দাম বেড়ে যাবে। তাই আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আদায় বাড়াতে গিয়ে এনবিআর পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।’
একই মত জানিয়ে সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ধরি একটি সাবান উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি ১০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হলো, তবে ৫০ টাকার সাবানের দাম ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকা হবে। এই সাবানটি ধনী-দরিদ্র সবাইকে একই দাম দিয়ে কিনতে হবে। ধনী ব্যক্তির জন্য বাড়তি দাম দিতে কষ্ট না হলেও একজন দরিদ্র ব্যক্তির জন্য তা যথেষ্ট ভোগান্তির। তাই ভ্যাটের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ আয়ের মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো হবে। এমনিতেই এখন জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাটের পরিমাণ বাড়ানো হলে তাদের ওপর খরচের চাপ আরও বাড়বে।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনিবআরের বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আইএমএফের পরামর্শ মানতে গিয়ে শতাধিক পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি, প্রত্যাহার ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে হচ্ছে। ভ্যাটের আদায় বাড়ানোর জন্য এনবিআরও তা মেনে নিয়েছে। এতে এসব পণ্য উৎপাদন এবং আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত দাম বেড়ে যাবে। অন্যদিকে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এতেও দাম বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দাম বাড়া ঠেকাতে অন্য কোনো সুবিধা দিয়ে উৎপাদন ও আমদানি খরচ কমানো যায় কি না, তা নিয়ে হিসাব করা হচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী করা যায়।’
আইএমএফ থেকে এনবিআরকে জানানো হয়েছে, প্রতি অর্থবছরে শুধু আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় সরকার গড়ে ৪৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভ্যাট অব্যাহতিতেও এ অর্থের সমান আদায় কম হয়। অব্যাহতি তুলে নেওয়া হলে এ অর্থ নিশ্চিত আদায় হবে।
আইএমএফের কাছে জমা দেওয়া ভ্যাট অব্যাহতি বা প্রত্যাহার-সম্পর্কিত এনবিআরের তৈরি প্রতিবেদন থেকে পণ্য বাছাই করে আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্তিতে এনবিআর কাজ করছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ করা নেই। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পলি ব্যাগের পরিবর্তে জিও ব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরোনো ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। পাইকারি/খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের ব্যবসাসংশ্লিষ্ট এবং ভ্যাটের আওতাবহির্ভূত। পরিবহন সেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইনের প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৪৮৯ এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক পণ্য, জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া একই তফসিল অনুযায়ী প্রায় ৫০টি সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রায় ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত।’