![বাংলাদেশের সুখ-দুঃখের বিশ্বকাপ](uploads/2024/06/07/BD-Team-T20-World-Cup-Histo-1717767470.jpg)
ক্রিকেটের বৈশ্বিক বিপ্লবকে অগ্রাধিকার দিয়ে টি-টোয়েন্টির সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটকে আইসিসি পরিচিত করিয়ে দেয় ২০০৪ সালে। নাতিদীর্ঘ এই ফরম্যাটের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলতে মাঠে নেমেছিল ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের নারী দল। যে ম্যাচে কিউই নারীর জয়লাভ করে ৯ রানে। এই ফরম্যাটে পুরুষ দলের প্রথমেও কিন্তু রয়েছে নিউজিল্যান্ডের নাম। সংস্করণটির ছেলেদের আন্তর্জাতিক ম্যাচেও প্রথমে মাঠে নেমেছিল নিউজিল্যান্ড। ২০০৫ সালের সেই ম্যাচে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার কাছে তারা হেরেছিল ৪৪ রানের ব্যবধানে।
এর প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশ এই ফরম্যাটে খেলেছিল তাদের প্রথম ম্যাচ। খুলনায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই দলের প্রথম সেই লড়াইয়ে মাশরাফির অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ৪৩ রানে জিতে শুভ সূচনা করেছিল স্বাগতিকরা। ব্যাট হাতে ২৬ বলে ৩৬ ও বল হাতে তিনি শিকার করেন ১ উইকেট। বছরখানেক পর টি-টোয়েন্টির চতুর্ভুজাকার সিরিজে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেও জয়ের স্বাদ পায় টাইগাররা। নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচই জিতে এই ফরম্যাটকে নিজেদের করে নেওয়ার বার্তা দেয় বাংলাদেশ।
চার-ছক্কার এই ফরম্যাট ক্রমেই হয়ে ওঠে জনপ্রিয়। সেই জনপ্রিয়তাকে গুরুত্ব দিয়েই ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আয়োজন করে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রায় ৫ মাস পর। যার প্রথম আসর বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১২ দল নিয়ে অনুষ্ঠিত সেই আসরে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এ’ গ্রুপে পড়ে বাংলাদেশ, যেখানে অন্য দলটি ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টি-টোয়েন্টির ভবিষ্যৎ দিনগুলোতে ত্রাস হয়ে যাওয়া সেই উইন্ডিজকে উড়িয়েই বাংলাদেশ শুরু করে বিশ্বকাপ যাত্রা। আফতাব-আশরাফুলের ১০৯ রানের জুটিতে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিল ৬ উইকেটের ব্যবধানে। যে ম্যাচে ২৩ বলে ফিফটি করে টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড গড়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সুপার এইটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় ছক্কা হাঁকানোর ম্যাচে ১২ বলে ফিফটি করে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন ভারতের যুবরাজ সিং। গ্রুপ পর্বে উইন্ডিজের বিপক্ষে ওই জয়েই আশরাফুলের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পা রাখে সুপার এইটে।
সে বছর বিশ্ব আসরে বাংলাদেশ অনেকটাই স্বপ্নের ভেলায় চড়ে বিচরণ করছিল। একই বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলে খেলে সুপার এইটে। ওয়ানডে বিশ্বকাপে সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি জয় পেলেও, টি-টোয়েন্টির গ্রুপ পর্বে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারতে হয় তাদের বিপক্ষে। বিশ্বকাপের আগে দুই জয় ও বিশ্বকাপের শুরুটা জয় দিয়ে শুরু করে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে অবস্থান করা বাংলাদেশ বাস্তবতায় ফেরে সুপার এইটে। তিন প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের কাছে পাত্তাই পায়নি আশরাফুলরা। ব্রেট লি হ্যাটট্রিক করেন বাংলাদেশের বিপক্ষে, যা ছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম। বাংলাদেশ হারে ৯ উইকেটের বড় ব্যবধানে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৮৩ রানে অলআউট হয়ে হারতে হয় ৬৪ রানে। নিজেদের শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষেও হার মানে ৪ উইকেটে। প্রথম বিশ্বকাপেই বাংলাদেশের এই ফরম্যাটে সামর্থ্যের চিত্রটা সামনে চলে আসে। যদিও সেই আসরই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল বিশ্বকাপ হিসেবেই বিবেচিত হয়। না হয়ে উপায় কী? এরপর তো আর কখনোই খেলার সুযোগ হয়নি দ্বিতীয় রাউন্ডে। বেশ কয়েকবার তো খেলতে হয়েছে প্রাথমিক পর্বেও। পরের তিন বিশ্বকাপে আর কোনো ম্যাচ জেতা হয়নি বাংলাদেশের। ইংল্যান্ডের মাটিতে ২০০৯ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে হারের পর হারতে হয় আয়ারল্যান্ডের কাছেও। অথচ গ্রুপে আয়ারল্যান্ড থাকায় আশা করা হয়েছিল বাংলাদেশ এবারও জায়গা করে নিবে সুপার এইটে। এর পরই দলের অধিনায়কত্ব হারান মোহাম্মদ আশরাফুল।
১০ মাস পর ২০১০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া দুই দলের বিপক্ষেই জয়ের দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয় বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে আশরাফুল ও সাকিবের ৯১ রানের জুটিতে জয়ের কাছাকাছি গিয়েও ফিরতে হয়েছিল ২১ রানের পরাজয় নিয়ে। অজিদের বিপক্ষে আগে বোলিং করে ৫৭ রানেই তাদের ৫ উইকেট তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মাইক হাসির ২৯ বলে ৪৭ রানে তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৪১ রানে। যেই রান তাড়া করতে নেমে হতশ্রী ব্যাটিংয়ে ২৭ রানের হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে আসে সাকিবের বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার মাটিতে পরের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলতে নামে দুই বছর আগে ঘরের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে তাদের ৪-০ ব্যবধানে ‘বাংলাওয়াশ’ করার সুখস্মৃতি নিয়ে। সেই সুখস্মৃতি মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ৫৮ বলে তার ১২৩ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে ১৯১ রানের বড় লক্ষ্যে খেলতে নামা বাংলাদেশ গুটিয়ে যায় ১৩২ রানে। পরাজিত হয় ৫৯ রানে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের ৫৪ বলে ৮৪ রানে ভর করে ১৭৫ রানের সংগ্রহ দাঁড় করালেও বোলিং ব্যর্থতায় সেই ম্যাচও হারে ৮ উইকেটে।
পরের বছর ঘরের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে আটে না থাকায় খেলতে হয়েছিল বাছাইপর্ব। আফগানিস্তান ও নেপালের বিপক্ষে ৯ ও ৮ উইকেটের বড় ব্যবধানে জেতা দলকেই হংকংয়ের কাছে হারতে হয়েছিল ২ উইকেটে। ১১.৫ ওভারের ভেতর হংকংকে জিততে না দেওয়ায় মূলপর্বে পা রাখে বাংলাদেশ। যদিও মূলপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৭৩, ভারতের বিপক্ষে ৮ উইকেটে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে হারতে হয়েছিল ৫০ রানে। কোয়ালিফায়ারে দুই ম্যাচ জেতার পর মূলপর্বের তিন ম্যাচসহ হারতে হয় টানা ৪ ম্যাচ। ফলে টানা চার আসর মূলপর্বে জয়হীন থাকেন মুশফিকরা। ঘরের মাঠে হতাশ করেন তারা সমর্থকদের।
ভারতের মাটিতে পরের আসরে বাংলাদেশ যায় আত্মবিশ্বাসের ভাণ্ডার সঙ্গে নিয়ে। টি-টোয়েন্টি সংস্করণের এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হারলেও ভালো পারফরম্যান্সের আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভারত গিয়েও পূর্বের ন্যায় হতাশ করেন মাশরাফিরা। সেই বিশ্বকাপের হতাশা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সমর্থকরা। বাছাইপর্বে নেদারল্যান্ডস ও ওমানের বিপক্ষে জয় এবং আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টির কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগিতে মূলপর্বে জায়গা নিশ্চিত করলেও ভারতের বিপক্ষে নিশ্চিত জয়ের ম্যাচে ৩ বলে ২ রান নিতে না পেরে ম্যাচ বিলিয়ে দিয়ে আসেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ১ রানের পরাজয়ের সেই হতাশা এখনো কুরেকুরে খায় সমর্থকদের। পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয় তো আছেই।
দিন বদলের বার্তা নিয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের নেতৃত্বে ২০২১ বিশ্বকাপে যায় বাংলাদেশ। সঙ্গে ছিল ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারানোর আত্মবিশ্বাস। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর মূলপর্বে আর কখনোই ম্যাচ জিততে না পারা বাংলাদেশ এবার মুছে দেবে সেই ব্যর্থতা, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল সমর্থকদের। আশার বাণী ছিল অধিনায়কের মুখেও। কিন্তু বাছাইপর্বে প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ রানে হেরে সেখান থেকেই তৈরি হয় বিদায়ঘণ্টা বেজে যাওয়ার শঙ্কা। বাকি দুই ম্যাচে ওমান ও পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে মূলপর্বে জায়গা করে নিলেও দেখা মেলে এক নির্বিষ দলনেতার অধীনে থাকা অদক্ষ সৈন্যদের বেহাল রূপ। সংবাদ সম্মেলনে চলতে থাকে কথার লড়াই। দলের খেলোয়াড় থেকে বোর্ডের কর্মকর্তা আর সবশেষ খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরাও তাতে যোগ দেন। মাঠের পারফরম্যান্সে আসেনি কোনো পরিবর্তন। সেবারও হারতে হয়েছিল মূল পর্বের সব ম্যাচ। টাইগারখ্যাত বাংলাদেশ দলকে মনে হয়েছে যেন নখদন্তহীন এক বাঘ। হুঙ্কার দেয় কিন্তু জয় হাতছাড়া হয়ে যায়।
দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন সাকিব আল হাসান ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। সেই আসরে নেদারল্যান্ডস ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাওয়া দুটি জয়ই ২০০৭ আসরের পর মূলপর্বে পাওয়া বাংলাদেশের জয়ের সম্বল। ভারতের বিপক্ষে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে লিটনের ঝোড়ো সূচনার পরও খেই হারানো বাংলাদেশ ডিএল পদ্ধতিতে হারের স্বাদ পায় ৫ রানে। তা ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রুশোর ঝোড়ো শতকে পাত্তা না পাওয়া সাকিবরা হারেন ১০৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। নেদারল্যান্ডসের কাছে প্রোটিয়ারা ১৩ রানে হারলে বাংলাদেশের সামনে পাকিস্তানকে হারাতে পারলেই সেমিফাইনালে পা রাখার সুযোগ চলে আসে। এমন ম্যাচে বাজে আম্পায়ারিং ও ব্যাটিং ব্যর্থতায় ৫ উইকেটে হেরে শেষ হয় বাংলাদেশের সেমিফাইনালের স্বপ্ন।
এবারের আসরেও বাংলাদেশের প্রস্তুতি মানসম্মত নয়। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪-১ এ সিরিজ জয়ের পর বিশ্বকাপের স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নাকানিচুবানি খেয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ খুইয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। এমন হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর সমর্থকরা পাচ্ছেন না বেশি কিছু আশা করার সাহস। ঘুণে ধরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভাগ্যটাকে রঙিন করা আদৌ সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না অনেকের কাছেই। টি-টোয়েন্টি সংস্করণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জয় দিয়ে যেভাবে শুরু করেছিল বিশ্বকাপে কখনোই ছিল না তার ছিঁটেফোঁটা। দেশ ছাড়ার আগে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও বলে গেছেন, ‘প্রত্যাশা খুব একটা করার দরকার নেই।’