রাহুল দ্রাবিড়, দ্য ওয়াল। ভারতীয় ক্রিকেটে পরিপূর্ণ এক অধ্যায়ের নাম!
ক্রিকেটার দ্রাবিড় তো বটেই, একজন মানুষ দ্রাবিড়ও যে কারও জন্য আদর্শিক ও অনুকরণীয় চরিত্র। আপনি সফল হতে চান? এজন দ্রাবিড়কে দেখুন, তার জীবন দর্শন মেনে চলুন। আর আপনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলেও দ্রাবিড়কে দেখুন। খেলোয়াড় ও কোচিং ক্যারিয়ারে জীবনের জয়গানই রচনা করে গেছেন দ্রাবিড়। ক্রিকেট তাকে বঞ্চিত করেনি, জীবনও না।
হ্যাঁ, ক্রিকেট কিংবা জীবন, দুই জায়গাতেই উত্থান-পতন আছে। সাফল্য ব্যর্থতা আছে। কথায় বলে মানুষ শুধু সফলদেরই মনে রাখে। ভুলে যায় ব্যর্থদের। রাহুল দ্রাবিড় জীবনে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু নিজেকে ভুলতে দেননি কাউকে।
১৬ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দ্রাবিড় যে সেবা দিয়ে গেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট তা মনে রাখতে বাধ্য। আগ্রাসী কোনো পেসারের ১৫০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা বলও অবলীলায় ডিফেন্স করে দিতেন দ্রাবিড়। শান্ত-সৌম্য ভঙ্গিতেই প্রতিপক্ষকে ভেঙে চুরমার করতেন। দ্রাবিড়ের ডিফেন্স ভেদ করা ছিল যেকোনো বোলারের জন্য কঠিন। তাই তো তার আদুরে নাম হয়ে যায় ‘দ্য ওয়াল’। ওয়ানডে ও টেস্ট- দুই ফরম্যাটেই ১০ হাজারের বেশি রান করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল এই ব্যাটারের একটা বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পাওয়া হয়নি।
খুঁজলে এমন অনেককে পাওয়া যাবে, যারা খেলোয়াড় হিসেবে খুব সফল, কিন্তু বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। দ্রাবিড়কে তাদের থেকে একটু আলাদাই বলতে হবে। কারণ বিশ্বকাপের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম রূপটা বোধহয় তিনিই দেখেছেন। ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে ট্রফি জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরে সোনালি ট্রফিতে হাতের পরশ বোলাতে পারেননি। ২০০৭ সালে পরের বিশ্বকাপ আসতে আসতে ভারতীয় দলের নেতৃত্বভার তুলে দেওয়া হয়েছিল দ্রাবিড়ের কাঁধে। ফেভারিট হিসেবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল তার দল। কিন্তু প্রথমে বাংলাদেশ, পরে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটেছিল দ্রাবিড়ের ভারতের। দেশটির খেলোয়াড়দের সেবার ফিরতে হয়েছিল রাতের অন্ধকারে পুলিশি প্রহরায়। পোর্ট অব স্পেনে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হারের পর ভারতীয় ড্রেসিংরুমের বেশ কয়েকটি ছবি এখনো ব্যর্থতার মূর্ত প্রতীক হয়ে আছে। যেগুলোতে দ্রাবিড়ের থমথমে মুখ আর তার শূন্যে চাহনিটাই বলে দেয়, কতটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
১৭ বছর পর সেই ক্যারিবীয় সাগরপাড়েই এবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেলেন দ্রাবিড়। খেলোয়াড় নয়, কোচের ভূমিকায়। কিন্তু বিশ্বকাপ তো। যা দ্রাবিড়ের জন্য মরীচিকা হয়েই দাঁড়িয়েছিল! খেলোয়াড় হিসেবে যেমন, কোচ হিসেবেও। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ভারতের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় একজন দ্রাবিড়ের যেন বৃত্ত পূরণ। যে বৃত্ত সাফল্য-ব্যর্থতার গল্পে ভরা। পরশু বার্বাডোসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভারত পায় রুদ্ধশ্বাস এক জয়। প্রোটিয়াদের দিকেই ঝুঁকে যাওয়া ম্যাচটা দারুণ নৈপুণ্যে নিজেদের দিকে টানেন হার্দিক পান্ডিয়া, জাসপ্রিত বুমরাহরা। ভারত যখন ফের ম্যাচটা নিজেদের মুঠোতে টানে, তখন রাহুল দ্রাবিড়ের উচ্ছ্বাসটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ১৭ বছরের ব্যবধানে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ড্রেসিংরুমের ধরা পড়া রাহুল দ্রাবিড়কে পাশাপাশি বাঁধিয়ে রাখা যেতেই পারে। জীবনের কোনো এক জায়গায় যিনি চূড়ান্ত ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েননি। নিজের মেধাকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর সততার মধ্যে এগিয়ে চলেছেন। একদিন সবকিছু হারালেও ১৭ বছর পর ঠিক একই জায়গায় পরিপূর্ণ হলেন।
কোচ হিসেবে এই বিশ্বকাপ ট্রফির ছোঁয়াও কি আর খুব সহজে পেলেন দ্রাবিড়? ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার পর দীর্ঘ সময় ভারতের ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ২০১৮ সালে ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয় করে দ্রাবিড়ের কোচিংয়েই। কিন্তু ২০২১ সালে জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে দু-দুবার বিশ্বকাপ জয়ের কাছে গিয়েও ব্যর্থ হন দ্রাবিড়। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারে তার দল। গত বছর ঘরের মাঠে হারে ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগেই কোচ দ্রাবিড় বিদায়ের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এবার না হলে হয়তো কখনোই হতো না। খেলোয়াড় ও কোচিং মিলিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছরের ক্যারিয়ারে একটা বিশ্বকাপ দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকতো দ্রাবিড়ের। ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা তাই ট্রফি জয়ের পর বললেন, ‘আমাদের যে কারও চেয়ে ট্রফিটি তারই (দ্রাবিড়ের) বেশি প্রাপ্য ছিল বলে আমি মনে করি। গত ২০-২৫ বছর ধরে ভারতের ক্রিকেটের জন্য তিনি যা করেছেন, আমার মতে, তার অর্জনের ঝুলিতে এটিই শুধু বাকি ছিল।’
সত্যিই তাই। অর্জন আর প্রাপ্তিতে একজন দ্রাবিড় এখন পরিপূর্ণ।