![নিরাপদ মাতৃত্বে করণীয়](uploads/2024/05/22/a-1716357874.jpg)
মাতৃত্ব যেকোনো মেয়ের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ মাতৃত্ব একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। গর্ভবতী মায়েদের প্রতি উদাসীনতা নিরাপদ মাতৃত্বে ব্যাঘাত ঘটায়। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এই উদাসীনতা বেশি লক্ষ করা যায়। অথচ আমরা ভুলে যাই মা সুস্থ থাকলে তবেই একটি সুস্থ-স্বাভাবিক নবজাতক প্রসব করতে পারবে। মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হলে তবেই নবজাতকেরও স্বাস্থ্য নিরাপদ হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, শিশু প্রসবের ৪২ দিনের মধ্যে মায়ের মৃত্যু ঘটলে সেটিকে মাতৃমৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তবে মাতৃমৃত্যুর শতকরা ৬০ ভাগ হয় প্রসবের পরপরই। প্রসবের এক দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটে ৫০ শতাংশ মায়ের। ১৯৮৭ সালে কেনিয়ায় নাইরোবি কনফারেন্স এ নিরাপদ মাতৃত্বের ঘোষণা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ২০০০ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ মাতৃমৃত্যু কমানো। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ এ বিষয় অনুমোদন দেয়। ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগ টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। ২৮ মে আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হলেও আমাদের দেশে নিরাপদ মাতৃত্ব কতটা কার্যকর, সেই বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতি ১ লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ মা মারা যান। বর্তমানে বাংলাদেশের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নে ১ লাখ ডেলিভারির মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০ জনে নিয়ে আসা। তবে উন্নত দেশগুলোতেও মাতৃমৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকায় মাতৃমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি এবং তা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। এ ছাড়া প্রসবকালীন বিভিন্ন জটিলতা, খিঁচুনি, উচ্চ রক্তচাপ, হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়া এসব কারণেও মাতৃমৃত্যু ঘটে। বাল্যবিবাহ এবং অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ মূলত এসব প্রসব জটিলতা সৃষ্টি করে। শুধু বর্তমান সময়েই নয়, অনেক আগে থেকেই মাতৃমৃত্যু একটি ভয়ানক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিখ্যাত সম্রাজ্ঞী মমতাজ, যাকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান। সেই মমতাজও মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ১৪তম সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যান।
গর্ভকালীন জটিলতা পরবর্তী সময়ে মাতৃমৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গর্ভকালীন ঝুঁকি যেসব লক্ষণে বোঝা যায়, তার মধ্যে যোনিপথে রক্তপাত অনেক বড় ঝুঁকি নির্দেশ করে। এ ছাড়া গর্ভকালে প্রতি মাসে ওজন না বাড়া, রক্তশূন্যতা, শরীরে পানি আসা, তীব্র মাথাব্যথা, গর্ভাবস্থায় তিন মাস পরও অত্যধিক বমি হওয়া, খিঁচুনি এবং প্রচণ্ড জ্বর হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় এসব লক্ষণ দেখা দিলে মাতৃমৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। কোনো গর্ভবতী নারীর মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। প্রসবকালীন ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য বাচ্চা গর্ভে আসার পরপরই কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন-
কিছু অর্থ জমা রাখা। যেন যেকোনো আকস্মিক প্রয়োজনে ঝামেলায় পড়তে না হয়। কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিবে সেটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা। প্রয়োজনে যেন রক্ত পাওয়া যায় এজন্য আগে থেকে রক্তদাতা ঠিক করে রাখা। গর্ভাবস্থায় কোনো সমস্যা হলে সেটি সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানানো। একজন চিকিৎসকের অধীনে রেগুলার চেকআপ করা এবং তার অধীনেই বাচ্চা জন্ম দেওয়া; যেন সেই চিকিৎসক গর্ভবতী নারীর সমস্যাগুলো শুরু থেকেই চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারেন।
গর্ভধারণ অবস্থায় প্রতিটি নারীকে নিম্নোক্ত কাজগুলো করা উচিত: গর্ভধারণের ৪ থেকে ৮ মাসের মধ্যে মাকে দুই ডোজ টিটি টিকা নেওয়া। গর্ভবতী মাকে বেশি করে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খাওয়ানো। যেমন- ফলমূল, বিভিন্ন রংবেরঙের শাকসবজি, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি। প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা।
ভারী কাজ না করা। বিশ্রাম করা। নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন- প্রতিটি এলাকায় কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা। দক্ষ চিকিৎসক গড়ে তোলা। অদক্ষ কিংবা অপেশাদার কারও কাছে যেন সন্তান প্রসব না করায় সেই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা। নিরাপদ মাতৃত্ববিষয়ক সেমিনার আয়োজন করা। প্রান্তিক পর্যায়ের গর্ভবতী নারীরাও যেন সঠিক সময়ে সঠিক সেবা পায় সেটি নিশ্চিত করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে চারটি স্তম্ভ সাজিয়েছে। সেগুলো হলো পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব এবং জরুরি প্রসূতি সেবা।
মাতৃমৃত্যুর হার এবং মাতৃত্বকালীন মৃত্যু উভয়ই ‘প্রতিরোধের উচ্চ হারের সঙ্গে যুক্ত’। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যুগ্ম কমিশন মাতৃমৃত্যুর হারকে ‘সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করে এবং এটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার গুণগত মান নির্ণয় করার জন্য ব্যবহার করে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমে এলেও, তা এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি না করলে অকালে অনেক প্রাণ ঝরে পড়বে। নবজাতক জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই হারাবে তার মাকে। আমাদের উচিত মাতৃমৃত্যু নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা, এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করা এবং বাল্যবিয়ে রোধ করা। তবেই মাতৃমৃত্যু হার কমানো সম্ভব।
জাহ্নবী