![নারী এবং পরিবেশ](uploads/2024/06/05/a-1717569716.jpg)
নারী এবং পরিবেশ যেন একে অপরের পরিপূরক। আদিকাল থেকে নারীদের পরিবেশরক্ষাকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারীর জীবন-জীবিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে পরিবেশ ও প্রকৃতির। উন্নয়নশীল দেশ ও অনুন্নত দেশের নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজের জন্য অনেকাংশে নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির যে বিপন্নতা দেখা দিয়েছে তার ক্ষতিকর প্রভাব নারীকেই ভোগ করতে হয় বেশি। নারীর ওপর পরিবেশের প্রভাব এবং পরিবেশ রক্ষায় নারীর ভূমিকা নিয়ে লিখেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন এবং সাজলিন মেহজাবীন চৌধুরী
নারীর ওপর পরিবেশের প্রভাব
একবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী জলবায়ু সংকট। পৃথিবীর উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং চরম তাপমাত্রা বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা এবং তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। আর নারীরা এই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থায় পড়েন নারীরা। নারী কাজ হারান, অপুষ্টির শিকার হন, স্বাস্থ্যহানি হয়। পুরুষরা খুব দ্রুত অন্য পেশায় নিজেদের স্থানান্তরিত করে ফেলতে পারেন। সেই তুলনায় নারীরা পারেন না। এ কারণেও নারীর জীবন পুরুষের তুলনায় বিপন্ন হয় বেশি।
আরডিআরএসের এগ্রিকালচার অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ টিম লিডার ডক্টর এ কে এম সালাহ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। আর এটার সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে নারী সমাজের ওপর। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। আমরা অনেক সময় গ্রামাঞ্চলে দেখেছি, একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন নারীরা, অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন তারাই। সবার সার্বিক সহযোগিতাই পারে এই অবস্থার অবসান ঘটাতে। এর জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।’
তা ছাড়া গ্রামীণ সমাজে খাদ্য, পানি, জ্বালানি সংরক্ষণ এবং অন্যান্য গৃহস্থালি কাজগুলোর দায়িত্ব নারীকেই বহন করতে হয়। জলবায়ুর চরম প্রভাবে খরা, বন্যা, বৃষ্টিপাতের সময় নারীরা দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে এবং জীবিকার সংস্থান সুরক্ষিত করার জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে বাধ্য হন। তাপ, খরা এবং চরম তাপমাত্রার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে যখন পানির উৎস শুকিয়ে যায়, তখন অনেক জায়গাতেই নারীরা রান্না, গোসল, ধোয়ার কাজ ইত্যাদির জন্য পানির সন্ধানে মাইলের পর মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে বাধ্য হন। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের একটি জরিপে পানি সংগ্রহকারী নারী-পুরুষের ভূমিকায় ভিন্নতা দেখা গেছে। ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে এ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ পুরুষ। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছে।
আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়।
তা ছাড়া জলবায়ু সংকট পরিবারগুলোর ওপর অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করে। ফলে মেয়েদের খুব কম বয়সে বিয়ে দেওয়াটাকে পরিবারের খরচ কমানোর বিকল্প হিসেবে দেখা হয়। তা ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুজ্বর, জিকা ভাইরাস এবং ম্যালেরিয়ার মতো রোগের বিস্তার যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে, যা মাতৃত্বের পাশাপাশি নবজাতকের স্বাস্থ্যকেও আশঙ্কার মুখে ফেলে। এব গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ঢাকায় যারা গৃহকর্মী বা নিম্নআয়ের মানুষ, তাদের বেশির ভাগই এসেছেন জলবায়ুর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এদের ৫৬ শতাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদীভাঙনের শিকার। বাকিরা আসছেন উত্তরাঞ্চলের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ওপর মানুষের হাত নেই। কিন্তু মানবসৃষ্ট যে কারণগুলোর জন্য জলবায়ুর এই পরিবর্তন, তা নিরসনে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দরকার। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা বা সুরক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে যেখানে ভূমিহীন, আদিবাসী, প্রতিবন্ধীসহ সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার দুর্বল অবস্থানের নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য লাগাতার ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে শামিল হতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় নারীর ভূমিকা
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশির ভাগ মানুষই পরিবেশের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। চাষাবাদ থেকে শুরু করে গবাদিপশু পালন, রান্নাবান্না কিংবা জলাশয় থেকে মাছ সংগ্রহ সবকিছুর সঙ্গে পরিবেশ জড়িত। ১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে পরিবেশের সঙ্গে নারীর সংযোগ এস্টার বোসেরুপ তার বই ‘ওমেনস রোল ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট’-এ উল্লেখ করেছিলেন। বোসেরুপ প্রচলিত উন্নয়ন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন; যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আধুনিকীকরণে নারীদের অবদানকে প্রান্তিক করেছে। বোসেরুপের কাজ হাইলাইট করে যে, কীভাবে নারীদের কৃষি চর্চা, সম্পদ ব্যবস্থাপনার কৌশল এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের জ্ঞান পরিবেশগত স্থায়িত্ব এবং স্থিতিস্থাপকতার জন্য অপরিহার্য।
টেকসই উন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যমাত্রায় নারীকে সহায়ক ভূমিকা রাখতে হয়। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানীরা ধারণা দেন, কৃষি সভ্যতা তার আলোকিত পথ তৈরি করে নারীর হাত ধরেই। বন্যদশায় গুহাবাসী মানুষরা ফলমূল কুড়িয়ে এনে তাদের প্রতিদিনের খাবার সংস্থান করত। সময়ের সঙ্গে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল বন্য মানুষরা একসময় সভ্য হলো। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে নারীর যে অবিচ্ছেদ্য বাঁধন, সেখানে আজ অবধি চিড় ধরেনি। বর্তমানে যেভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তাতে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের এই ক্ষতি থেকে নারীরাও তাদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। বাড়ির আশপাশে একটি সবজি কিংবা ফুলের বাগান যেভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করে এতে পুরো অবদানই নারীর। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পুষ্টিকর স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সংস্থান করে সবাইকে সুস্থ রাখাও তাদের একপ্রকার দায়বদ্ধতা। বর্তমানে বড় বড় দালানের ছাদের ওপরে যদি একটি সবজি এবং ফুলের বাগান থাকে তাহলে পরিবেশ রক্ষা পায়। এই কাজটিও সাধারণত নারীরাই করেন। গ্রামে-গঞ্জে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ির আঙিনায় কয়েকটি গাছ রোপণে নারীর অনন্য ভূমিকা অবশ্যই স্বীকার্য। সবুজ শাকসবজি যেভাবে শ্যামল প্রকৃতির বিশুদ্ধতার মাত্রাকে সুরক্ষিত করে, পাশাপাশি গৃহে উৎপাদিত কৃষিপণ্যে খাদ্যের যে পুষ্টিকর উপাদান তাও স্বাস্থ্যকে সবল ও সতেজ রাখে।
নারীর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে পরিবেশ ও প্রকৃতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এ কারণে প্রকৃতির বিপর্যয়ে নারীই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিপন্নতাকে প্রতিহত করার জন্য নারীই সবার আগে প্রতিবাদ করেন। নারীর পরিবেশ সচেতনতা, পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণের সহজাত প্রবণতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা প্রভৃতি নারী ও প্রকৃতির আন্তঃবিজড়িত সম্পর্ক নিয়ে চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটায়।
পৃথিবীতে প্রথম চাষাবাদের শুরু হয় নারীর হাত দিয়ে, নারীই ভূমি চষে পরিবারের খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিল। তাই নারীই নিজের এবং পরিবারের জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর তাগিদে পরিবেশ রক্ষার লড়াই শুরু করে। আজও যা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নামে সম্পদের যে অবাধ ব্যবহার চলছে, ফলে মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন নারী ও শিশুরা। তারা বাধ্য হয়ে প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করেন।
কর্মজীবী নারী কর্ম হারান। নারী ও শিশু অপুষ্টির শিকার হয়, সমাজের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যহানির শিকার হয়। পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য কর্মহীন অবস্থায় নারীরা একই স্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু পুরুষরা তাদের বাড়ির বাইরে গিয়েও কাজ করতে পারেন। এ কারণেও নারীর জীবন পুরুষদের তুলনায় বিপন্ন হয় বেশি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী হিসেবে নারীদের কথাই বলা হচ্ছে।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, নারীরা খামারের কাজ এবং সংশ্লিষ্ট গার্হস্থ্য খাদ্য উৎপাদন করে থাকেন। বর্তমানে অনেক নারীর কৃষিকাজে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। নারীরা শুধু ঘরে নয়, ঘরের বাইরেও পরিবেশ রক্ষায় সমান অবদান রেখে চলেছেন। অনুন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা উন্নত সব ধরনের দেশেই নারীরা আজ পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার। নারীদের এই সচেতনতা কিংবা অবদান পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
জাহ্নবী