![ইভ টিজিংকে ‘না’ বলুন](uploads/2024/06/12/a-1718171448.jpg)
ইভ টিজিং আমাদের দেশে নতুন কোনো শব্দ না। কয়েক বছর আগে এই বিষয়টি আমাদের দেশে ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক মেয়ে হতাশা, ক্ষোভ, রাগ অথবা মানসিক অস্থিরতায় দিন যাপন করেছে। এখন সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও ইভ টিজিং যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। শহর অঞ্চলে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও গ্রামে এখনো ইভ টিজিং চলছে। ইভ টিজিং নিয়ে লিখেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন
আনিকা ইদানীং স্কুলে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। বিষয়টি নজরে এলে স্কুলের শিক্ষিকা খোঁজ নিয়ে আসল ঘটনা জানতে পারেন। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি নয় বলে হেঁটেই সে প্রতিদিন স্কুলে যায়। পাড়ার মোড়ের এক চা দোকানদার প্রতিদিনই নানা ধরনের আজেবাজে কথা বলে! জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কই তিনি তো তার কাজ করছেন, কিছু বলেননি। কিন্তু আনিকা ঠিকই বুঝতে পারে এগুলো তাকে উদ্দেশ্য করে বলা। বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যেতে পারে, তা আনিকা বুঝতেই পারছে না। আর সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগ হারাচ্ছে।
এটা তো গেল একধরনের ইভ টিজিং। কী কী বিষয়কে আমরা ইভ টিজিং বলতে পারি? ইভ টিজিং বলতে সাধারণত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন কোনো মন্তব্য করা, ভয় দেখানো, তার নাম ধরে ডাকা এবং চিৎকার করা, বিকৃত নামে ডাকা, কোনো কিছু ছুঁড়ে দেওয়া, যোগ্যতা নিয়ে টিটকারী করা, তাকে নিয়ে অহেতুক হাস্যরস করা, রাস্তায় হাঁটতে বাধা দেওয়া, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা দেওয়া, প্রেমে সাড়া না দিলে হুমকি দেওয়া ইত্যাদি ইভ টিজিংয়ের মধ্যে পড়ে।
আমাদের দেশে কিশোরী বয়সী মেয়েরাই মূলত ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়। তবে একদম কম বয়সী মেয়েদের ইভ টিজিংয়ের ঘটনাও শোনা যায়। এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ মধ্যবয়সী নারীরাও এখানে ইভ টিজিংয়ের শিকার হন। আর এই ইভ টিজিংটা করছে কারা? যুবক, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৫, তাদের বিরুদ্ধেই ইভ টিজিংয়ের অভিযোগ বেশি। এই বয়সে অনেকেই বিপথে চলে যায়। পাড়ার সন্ত্রাসী বা মাস্তান হয়। তাছাড়া বস্তিতে বড় হওয়া তরুণদের মধ্যে এই ধরনের বাজে চিন্তা তৈরি হয়। মধ্য ও বৃদ্ধ বয়সের পুরুষও মেয়েদের নানাভাবে হয়রানি করছেন, তা আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই।
আমাদের দেশে ইভ টিজিংয়ের পেছনের কারণ কী? বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাব ইভ টিজিংয়ের অন্যতম কারণ। মেয়েদের হেয়প্রতিপন্ন করার একটা মানসিকতা এখনো আমাদের পরিবারগুলোয় দেখা যায়। পরিবারের ছেলেরা নারীকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার বিষয়টি সঠিকভাবে শেখেনি। ব্যক্তিগত, সামাজিক অস্থিরতাও ইভ টিজিংকে উসকানি দেয়। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা এ ধরনের অপরাধ করছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে দ্রুত। শাস্তি দিতে বিলম্ব হওয়া অনেক সময় অপরাধীদের সাহস বাড়িয়ে দেয়।’
ইভ টিজিং প্রতিরোধ
ইভ টিজিং বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের সদস্যও একে অপরকে সচেতন করতে পারেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষিকারা এ বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করতে পারেন। কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে সহযোগিতা করতে পারেন। রাস্তাঘাটে চলাচলকারী সাধারণ জনগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিজ্ঞ আদালত, ভ্রাম্যমাণ আদালত, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিকসহ সব সচেতন মানুষ এ বিষয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন।
ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাসরুমে ইভ টিজিং সম্পর্কে আলোচনা করতে এবং নেতিবাচক বিষয় তুলে ধরতে হবে। গণমাধ্যমে ইভ টিজিং উৎসাহিত হয় এ ধরনের বক্তব্য, বিজ্ঞাপন, নাটক কঠোরভাবে প্রচার না করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ইভ টিজিংয়ের ঘটনা ঘটলে ভিকটিমের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ইভ টিজিং প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
ইভ টিজিং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন ও এর প্রতিকার সম্পর্কে অ্যাডভোকেট সেলিনা আক্তার খবরের কাগজকে বলেন, ‘নারী ও শিশুনির্যাতন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০১৮)-এর ১০ ধারা মোতাবেক, যদি কোনো ব্যক্তি যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো অঙ্গ দ্বারা কোনো নারীর অঙ্গ স্পর্শ করে বা শ্লীলতাহানি করে, তাহলে ওই ব্যক্তিকে ৩ থেকে ১০ বছরের মধ্যে যেকোনো মেয়াদের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে, অতিরিক্ত অর্থদণ্ড দিতে হবে। নতুন আইনের ৯ নম্বর অধ্যাদেশে বলা হয়েছে যে, যদি কারও ইচ্ছাকৃত অসম্মানজনক কাজ কোনো নারী বা শিশুর শালীনতা হানি করে তাকে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। আর যদি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করা হয়, তবে অপরাধীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। ধর্ষণে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের সঙ্গে অতিরিক্ত অন্যূন ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কার্য করে অথবা তার সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, সংগীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে, তাহলে সে ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত যেকোনো ধরনের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। দণ্ডবিধির ১৮৬০ সালের আইনে ৫০৯ ধারা অনুসারে যদি কোনো ব্যক্তি নারীকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে অশ্লীল কথা বলে কিংবা অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে, তবে সে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশে দুটি আইন রয়েছে। এর ৭৫ ধারায় বলা হয়েছে, সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে এবং ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, নারীকে উত্ত্যক্ত কিংবা অপমান করে এমন কাজ করলে তিনি এক বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ইভ টিজিংয়ের শিকার হলে কী করবেন?
যদি কোনো নারী ইভ টিজিংয়ের শিকার হন, তাহলে ওই নারী সরাসরি থানায় গিয়ে ইভ টিজারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করতে পারেন। যদি কোনো কারণে থানায় মামলা না করা যায়, তাহলে ওই নারী সরাসরি কোর্টে গিয়েও মামলা করতে পারেন। আর যদি থানা অথবা কোর্টে গিয়ে মামলা করা সম্ভব না হয়, তাহলে ৯৯৯-এ কল করেও পুলিশের সহায়তা নিতে পারেন।
জাহ্নবী