চার হাজারেরও বেশি বছর আগে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল অর্থাৎ ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার কেন্দ্রভূমি মেসোপটেমিয়ার উর শহরে যা বর্তমানে তাল আল মুকায়ের শহর নামে পরিচিত সেখানে বাস করতেন এক কবি, যার নাম ‘এনহেদুয়ান্না’। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইতিহাসে বিশ্বের প্রথম কবি ছিলেন এনহেদুয়ান্না এবং তিনি ছিলেন একজন নারী। উত্তম পুরুষে প্রথম কবিতা লেখার কৃতিত্বও তার। এনহেদুয়ান্নার অর্থ হচ্ছে অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি শুধু পৃথিবীর প্রথম কবি নন, পৃথিবীর প্রথম প্রধান নারী পুরোহিতও ছিলেন বটে। সেই সময় এনহেদুয়ান্নার আগে কোনো নারী প্রধান পুরোহিত হননি। সুমেরীয় কবি এনহেদুয়ান্না মাত্র ২৭ বছর বয়সে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একটি দেবালয়ের। আক্কাদের অধিপতি সারগন ও তার স্ত্রী তাশলুলতুমের মেয়ে ছিলেন তিনি। অবশ্য তার পিতৃপরিচয় নিয়ে ভিন্নমতও শোনা যায়। অসামান্য মেধা, সততা ও কর্মনিষ্ঠার গুণে, সর্বোপরি দেবালয় নেতৃত্ব দেওয়ার বদৌলতে তৎকালীন আক্কাদিয়ানরা তাকে দেবীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।
কবি এনহেদুয়ান্না ইংরেজ কবি শেক্সপিয়ারের জন্মের প্রায় ৪০০০ বছর আগে, গ্রিক গীতিকবি স্যাফোর জন্মের ১৭০০ বছর এবং চারণকবি হোমারের জন্মের ১৫০০ বছর আগে রচনা করে গেছেন অনন্য ভাষাশৈলী ও শব্দচয়নে চমৎকার অনেক কবিতা; যা যুগ যুগ ধরে মেসোপটেমিয়ার বিদ্যালয় ও উপাসনালয়গুলোয় লেখকরা পাঠ করে আসছেন গভীর ভক্তিতে এবং এখনো তার রচনা বিস্ময় জাগিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে ঐতিহাসিকদের।
এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাকে দেবী হিসেবে পূজা করত। তার এসব লেখা পরবর্তীতে পাথরে খোদাই করা অবস্থায় পাওয়া যায়। আর সেখান থেকেই এই নারীর সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারে বিশ্ব। তার পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন। এই পদটি রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত পদ । সারগনের মৃত্যুর পর তার পুত্র রামিস সম্রাট হলেও এনহেদুয়ান্না তার স্বপদে বহাল থাকেন। ২২৮৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এনহেদুয়ান্না।
মূলত প্রার্থনাসংগীত এবং কবিতা লিখতেন তিনি। ৩৭টি প্রস্তরখণ্ড থেকে এনহেদুয়ান্নার প্রায় ৪০টিরও বেশি ভক্তিসংগীত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তবে দেবী ইনানাকে নিয়ে লেখা তার আরও কিছু স্তুতিগানের হদিস পেয়েছেন বলে গবেষকরা দাবি করেন। সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার। পরবর্তী সময়ে গ্রিকরা যাকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। এনহেদুয়ান্নার কাব্য প্রতিভা তৎকালীন মেসোপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লেখতে জানবেন। কবি এনহেদুয়ান্না তার রচনার মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এককথায় সাহিত্য অঙ্গনে তার অবদান অনস্বীকার্য।
২২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন কবি এনহেদুয়ান্না। তার ৩৫ বছরের এই ছোট্ট জীবনে সংসার পাতেননি তিনি। অনুমান করা হয় যে, রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি। পৃথিবীর কোনো পুরুষের সঙ্গে তিনি সংসার না পাতলেও হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে কবিতার সঙ্গে সংসার পেতেছিলেন! তার হৃদয়ের শুদ্ধতম চিন্তা এবং কথাগুলোকে কবিতার রূপে এই পৃথিবীর বুকে বপন করে গেছেন।
জাহ্নবী