ঢাকা ২১ আষাঢ় ১৪৩১, শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪

কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে পুরোটা অনাবিষ্কৃত

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪, ১২:১০ পিএম
আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ০১:১২ পিএম
কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে পুরোটা অনাবিষ্কৃত
নজরুলসংগীতশিল্পী রত্না দাস ও সম্পা দাস। ছবি: শরিফ মাহমুদ

আগামী ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী। কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দৈনিক খবরের কাগজ-এর নারীবিষয়ক ফিচার পেজ ‘মমতাময়ী’র জন্য আমরা নজরুলপ্রেমী দুই বোনকে নিয়ে জ্যৈষ্ঠের এক বিকেলে ধানমন্ডির স্নিগ্ধ লেকের পাশে আয়োজন করেছিলাম এক আনন্দ আড্ডার। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন বড় বোন নজরুলসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক রত্না দাস এবং ছোট বোন শিক্ষক, নজরুল গবেষক ও নজরুলসংগীতশিল্পী ড. সম্পা দাস। সেই আড্ডার আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তাদের নজরুল ভাবনা, সংগীতচর্চা ও নতুন প্রজন্মের কাছে নজরুলকে প্রচারের দিকনির্দেশনা। এর চুম্বকীয় অংশ তুলে ধরছেন ফিচার সম্পাদক খালেদ আহমেদ

আড্ডার দিন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছালেন দুই বোন। পরিপাটি সাজে চুলে ফুল লাগিয়ে এসেছেন। এক গাল হেসে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে শুরু হলো ফটোসেশন। সবুজের চাদর মোড়ানো লেকের পাশে বেশ খানিকক্ষণ চলল ছবি তোলার কাজ। এরপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লেকের পাশে কাচঘেরা কফিশপে বসলাম আমরা। কফির কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হলো আড্ডা। প্রথমেই প্রশ্ন রাখলাম বড় বোন রত্না দাসের কাছে। আপনি তো দীর্ঘদিন নজরুলসংগীত সাধনা করছেন। নজরুলের গানের প্রতি আপনার আগ্রহটা বিশেষ কোন জায়গা থেকে এসেছে? মৃদু হেসে তিনি উত্তরে বললেন, আমি একজন নজরুল গানের শিল্পী। নজরুলের গানের শিল্পী বলতে গেলে যেটি বুঝায়, সেটি আসলে একেবারেই শৈশবে শুরু হয়েছিল। যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, সেটি আমার বাবার হাত ধরে। আমাদের দু-বোনের ক্ষেত্রে, আমি একটু পেছনে ফিরে বলতে চাই। আমার বাবা আমাদের পিঠেপিঠি দু-বোনকে স্থানীয় একাডেমিতে নিয়ে যেতেন। তখন আমরা প্রথমে নাচ শিখি। তবে নাচের সঙ্গে সঙ্গে বাবার স্কুলে যত শিক্ষক ছিলেন, তাদের আগমন ও বিদায় সংবর্ধনায় আমাকে আগের দিন মানপত্র পাঠ করতে হতো। সে মানপত্র পাঠ করার জন্য আমাকে বারবার ডাকা হতো। আমি বেশ কয়েকবার মানপত্র পড়েছি। সেই মানপত্র পাঠ দিয়েই শুরু আমার। সে মানপত্রটা আমার বাবা লিখতেন। আমার বাবা বাংলার শিক্ষক ছিলেন এবং তিনি যা লিখতেন, আমি আজ পর্যন্ত আমার বাবার মতো এখনো কারও লেখা পাই না। এত নান্দনিক, এত আকর্ষণীয় সেই লেখা। সেই মানপত্র পাঠের বিষয়টি আসলে আমার ভেতর রয়ে গিয়েছিল। শুরুটা এভাবেই ছোটবেলা থেকে । তারপর গান শিখেছি। একদিন বাড়িতে এসে বললাম, এখন তো নাচ করি, এবার একটু গানও করতে চাই। বাবা পড়াশোনার ব্যাপারে খুবই কড়া ছিলেন। খুবই কঠিন ছিলেন। বাবা তখন বললেন, যেকোনো একটি করতে হবে। তারপর গানটাকে বেছে নিলাম। সে সময় থেকেই আমাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো, এটা স্যারের  ছোট মেয়ে। আমি হারমোনিয়াম তো বাজাতেই পারতাম না, এমনকি দাঁড়াতেও পারতাম না। আমাকে টুলে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। আমাকে কেউ হয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে দিত। বাজিয়ে দিলে আমি গান গাইতাম এবং সবসময় বই পুরস্কার পেতাম। এভাবেই ছোটবেলার যাত্রা। একটু বড়বেলায় যখন আমরা গ্রাম ছেড়ে ঢাকা এলাম, তখন ছায়ানটে ভর্তি হই। সেখানে আমি উচ্চাঙ্গসংগীত শিখেছি শ্রী সুচিন্ত্য হালদার স্যারের কাছে, আর নজরুলসংগীত শিখেছি আমাদের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী শ্রদ্ধেয় নিলুফার ইয়াসমিন, মানস কুমার দাশ, সুধীন দাশ, আমাদের নজরুল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান খায়রুল আনাম শাকিল, সুমন চৌধুরী এবং অঞ্জলি রায়ের কাছে। আর একটু যোগ করব আমি, তিন কবির গান শিখেছি কলকাতার শিল্পী সর্বানী ম্যামের কাছে। বিয়ের পর থেকে পারিবারিক সমর্থন তো সম্পূর্ণরূপে পাচ্ছি। এর মধ্যে আমি নেদারল্যান্ডসের একটি সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। পরে আমি যেটা দেখলাম- গান করে, সংসার সামলে এবং চাকরি করে আসলে হয় না। তখন চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে আমি এই গানটাকে প্রাণের মধ্যে রেখে দিলাম। এখন পর্যন্ত আমি নজরুলকে নিয়ে যে কাজটি করি সেটা হচ্ছে- নজরুলের যে অপ্রকাশিত ও অপ্রচলিত গানগুলো রয়েছে, সেগুলো গাইতে চেষ্টা করি।

ছোট বোন সম্পা দাসের কাছে জানতে চাইলাম নজরুলসংগীত নিয়ে ভাবনার কথা। প্রশ্ন শুনে কফির কাপে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে কাচের দেয়ালের বাইরে স্বচ্ছ লেকের জলের দিকে তাকালেন কয়েক পলক। বুঝতে অসুবিধা হলো না তিনি নজরুল ভাবনায় ডুব দিয়েছেন। হঠাৎই আবার ফিরলেন বাস্তবে। তবে নিমগ্ন হয়ে জবাব দিলেন এভাবে- কাজী নজরুল ইসলামকে জেনারেলাইজ করা হয় আজকে একুশ শতকে দাঁড়িয়েও তিনি কেবলই প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, গানের কবি ইত্যাদি হিসেবে। কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিশীল জীবন ২২ বছর, বাকি সময় কবি নির্বাক ছিলেন। এই ২২ বছরের মধ্যে ১৩ বছর তিনি একেবারেই মগ্ন সাধকের মতো আধ্যাত্মিকভাবে সুর সাধনায় মগ্ন ছিলেন এবং ১৭টির মতো রাগ সৃষ্টি করেছেন। শুধু ভারতবর্ষের সংগীতের ইতিহাসে নয়, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে তার মতো এত বেশিসংখ্যক সংগীত কেউ রচনা করেননি। যদিও সংখ্যাধিক্য শিল্পের মানদণ্ড বিচার করার জন্য যথেষ্ট নয়। মানদণ্ড বলতে সাহিত্যের মানদণ্ডের যে জায়গা থেকে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন, সে কথা বলতে চাইছি না। কিন্তু তার গান যখন আমরা শুনি, সেখানে দেখা যায় যে সেটি কেবলই বাণী নয়। বাণী এবং সুরের মধ্য দিয়ে বাণী যখন আমরা পড়ি তখন এক রকমের ব্যঞ্জনা পাই। যখন সুর দেখি তখন পাই সুর এবং বাণী মিলিয়ে এক অভিন্ন ব্যঞ্জনা, এক ভিন্ন রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। তিনি প্রায় ৫ হাজার গান রচনা করেছেন। ৩ হাজার ৩৭৬টি গান সরকারিভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাদবাকি গান নানান চলচ্চিত্রে পাওয়া যায়, নাটকে পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়। যেটি ঘটেছে তা হলো- কবির জীবন বা জীবদ্দশায় তিনি অনেক অর্থকষ্টে ছিলেন। নানাবিধ কারণে কবি খুব চঞ্চল, অস্থির ছিলেন। আসলে অর্থনৈতিক দীনতা একটি মানুষকে ঠিক স্বাভাবিক মস্তিষ্কে, সৃজনশীল মস্তিষ্কে থাকার জন্য যে কতটা বিঘ্ন সৃষ্টি করে, কবি নজরুল সেটির একটি জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন। তিনি তার প্রথম পুত্রের মৃত্যুর পর কাফনের কাপড় কিনতে পারলেন না। তখন একজন এসে বলল- আপনি যদি গান লিখে দেন তা হলে আমি যে টাকাটা দেব, সে টাকা দিয়ে আপনি তার কাফনের কাপড় কিনতে পারবেন। তখন তিনি লিখেছিলেন, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি...।’ অর্থাৎ যখন তার এই প্রথম সন্তানের মৃত্যু হলো, তখন তিনি চিন্তা করলেন যে তিনি আর সাহিত্য রচনায় থাকবেন না। এবং একেবারেই হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে এই ভাবনা তাকে পরিবর্তন করল এবং কাব্যজগৎ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্বাসন দিয়ে তিনি সুরের জগতে চলে আসেন। এই জগতে তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন, এতটাই ধ্যানস্থ ছিলেন যে অসংখ্য গান লিখেছেন। তার গানের শেষ নেই, যে-ই এসেছে তাকেই দু-হাত ভরে দিয়েছেন। সুরকার কমল দাশগুপ্তকে তিনি বলেছেন, ‘শোনো, যদি একটা সমুদ্র থেকে দুই-চারটা নুড়ি চলে যায়, কিছু পানি চলে যায়, তা হলে কিন্তু সমুদ্রের পানি কখনো কমে না।’ এগুলো তার অনেক দীর্ঘ সুরজীবনের ইতিহাস। আমি যেটি বলতে চাই, যখন তিনি কাব্যজগৎ ছেড়ে দিলেন এবং সুরজগতে এলেন, তখন কিন্তু তার কাব্যের যে মেধাটা, সেটা কিন্তু সম্পূর্ণটাই সুরের ভেতরে প্রয়োগ করতে পারলেন। অর্থাৎ একজন কবি যখন সুরও জানেন, গ্রামার জানেন সংগীতের, সংগীতের রাগরাগিণী জানেন, তখন কিন্তু তার পক্ষে যে ডেলিভারিটা সেটি কিন্তু বিরাট একটি বিষয়। নজরুল যেটি করলেন, তার সেই মেধাটাকে সুরের ভেতরে ইনপুট করলেন এবং অসংখ্য রাগরাগিণী গানের যতগুলো ধারা রয়েছে- কী কাব্যগীতি, কী প্রেমের গান, কী হলি, ভজন, কীর্তন, শ্যামা, মানে বাংলা গানের যতগুলো স্টেশন রয়েছে, যতগুলো ধারা রয়েছে- সব ধারায় তিনি সংগীত সৃষ্টি করেছেন এবং এর পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি সুর এনেছেন। এই স্বল্প সময়ে তিনি কীভাবে এতকিছু আত্তীকরণ করেছেন, নিজের করে নিয়েছেন, আপন করে নিয়ে সেই মালা  গেঁথেছেন, এটি স্টিল আইডেন্টিফাই। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বব ডিলানের মতো সাহিত্যে বা সুরে সংগীতে নোবেলজয়ী না হলেও, সাধারণ মানুষের জীবনকে আশ্রয় করে তিনি যে সাহিত্য এবং সংগীত রচনা করেছেন, সেটি সব মানুষের জীবনে মহার্ঘ্য হয়ে আছে। তবে সে বিষয়টি মানুষকে জানতে হবে যে, তার কী কী ঐশ্বর্য আছে, তখনই আমরা অনুভব করব আসলে কতটুকু সম্পদ আমাদের রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেদের ঐশ্বর্যকে উদ্ঘাটন করতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমরা নিজেরাও সমৃদ্ধ হব না যে আমরা কাজী নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী, আমাদের একজন নজরুল রয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৪০০ গান রচনা করেছেন। অনেকে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের বা লালনের তুলনা করেন, আসলে কারও সাথে কারও তুলনা নাই। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব জায়গায় স্বকীয় মানদণ্ডে, স্বকীয় ব্যক্তিত্বে, স্বকীয় সৃষ্টিতে উজ্জ্বল। একটি শিল্প তখনই চিরকালের হয়, যখন সেটি মানুষের মনোজগতে বা অন্তর্জগতে বিশেষ প্রভাব ফেলে, মানুষ সেটা থেকে বের হতে পারে না। তখনই কিন্তু সেটি শিল্প হয়ে যায়। সেই অর্থেই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি প্রতিটি সৃজনশীল মানুষ আলাদা, তেমনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এবং লালনও আলাদা আলাদা স্বকীয় মাধুর্যে, স্বকীয় ব্যঞ্জনায় তারা স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের মানুষ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এখনো আমাদের কাছে ‍পুরোটা অনাবিষ্কৃত। এবং তার ভেতরে যে ঐশ্বর্য রয়েছে, সেগুলো উদ্ঘাটন হওয়া প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

এবার প্রশ্ন রাখলাম রত্না দাসের কাছে। বিশেষ দিবস ছাড়া নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান কম হওয়াটা আপনি কীভাবে দেখেন? জবাবে তিনি বলেন, শুধু নজরুলের প্রয়াণ আর জন্মদিনেই খোঁজ করে সবাই। কিন্তু নজরুল আসলে কতটা প্রাসঙ্গিক আমাদের জীবনাচরণে- সেই দিক থেকে নজরুলের গানকে প্রসার, সম্প্রসারণ যাই বলেন না কেন যদি সেটি করতে হয়, নজরুলকে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বময়। বিশ্বময় ছড়াতে গেলে বিশ্ব যা চায়- নজরুলের গানের আদি সুর, বাণী এগুলো ঠিক রেখে, নতুন করে সংগীত আয়োজনের সিদ্ধান্ত অবশ্যই নিতে হবে। কেননা পরবর্তী সময়ে এই যে আমাদের কবি, এত মেধাসম্পন্ন একজন কবি বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি আসবেন কি না, আমার তো মনে হয় না।

ফিরলাম সম্পা দাসের কাছে। প্রশ্ন ছিল- বর্তমান প্রজন্মের মানুষ কি নজরুলের চেতনাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে? উত্তরে তিনি বলেন, নজরুলের চেতনাকে বুঝতে হলে আগে নজরুলের চিন্তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে। নজরুলকে তো কেউ চিনলই না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, তারা যখন সাহিত্যিকদের কথা, রবীন্দ্রনাথের কথা, লালনের কথা বলেন, তখন কিন্তু নজরুলের প্রসঙ্গটি ইচ্ছে করেই তাদের কৌলীন্যবোধ থেকে সুকৌশলে এড়িয়ে যান এবং নজরুলকে মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা, তারা স্বীকৃতিই দিতে চান না।

আরেকটু সংযোজন করতে চাই, নজরুলকে আসলে কেউ হিন্দুর কবি বলেন, কেউ মুসলমানের কবি বলেন, যেটি নিয়ে খুব দ্বন্দ্ব বাঁধে, যুদ্ধ বাঁধে রীতিমতো। নজরুল কিন্তু মানবতার কবি, এই কথাটা কিন্তু কেউ বলে না। নজরুলকে সব সময় দ্রোহ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এক কথায় যদি বলতে চাই, তিনি মানবতার কবি। তিনি বলেছেন- ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ...।’ তিনি একাধারে শ্যামাসংগীত লিখেছেন, ইসলামিক গান রচনা করেছেন। ওনার ইসলামি গান ‘ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে’ না হলে আমাদের ঈদ সম্পূর্ণ হয় না, পূর্ণতা পায় না। তেমনই করে তার রচিত কালীর যে বন্দনা, প্রচুর শ্যামাসংগীত এসব ছাড়া আমাদের পুজো সম্পূর্ণ হয় না। তারপর তিনি নাটকের জন্য গান লিখেছেন স্বকণ্ঠে এবং ওনার সৃষ্ট রাগরাগিণী প্রচুর আছে। এত সীমাহীন বিস্ময় নজরুলকে কেন্দ্র করে, সারাজীবনেও এই বিস্ময় কাটবে না, ঘোর লাগা থাকবেই।

জাহ্নবী

মাহমুদা খাতুনের বইবাগান

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৪ পিএম
মাহমুদা খাতুনের বইবাগান
নিজ লাইব্রেরিতে বই পড়ছেন মাহমুদা খাতুন

দেশি-বিদেশি দুর্লভ সব বই দিয়ে নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল লাইব্রেরি। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করেছেন। অবসরে যাওয়ার পর নিজের সব সঞ্চয় দিয়ে নগরীর শিরোইল এলাকার দেওয়ান মঞ্জিলে গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি। দেড় হাজার বর্গফুটের এই বিশাল লাইব্রেরিতে রয়েছে ৫ হাজারের অধিক বই। যেখানে ভ্রমণ, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাসসহ নানা ধাঁচের দুর্লভ সব বই ও ম্যাগাজিন দিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রন্থাগারটি। যার গল্প বলছি, তার নাম মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা।

মাহমুদা খাতুন ১৯৭৩ সালে রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করতেন। অল্প বয়স থেকেই বইপড়ার প্রতি ছিল তার ভীষণ রকম আগ্রহ। পাঠ্যবইয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি প্রবন্ধটি মাহমুদা খাতুনের মনের কোথায় যেন স্থান করে নিয়েছিল। তখন থেকেই বই নিয়ে কাজ করার এক তীব্র তাড়না অনুভব করেন তিনি। কিন্তু শিক্ষাজীবনের নানারকম প্রতিবন্ধকতার কারণে সেই স্বপ্ন তখন আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠেনি। তবে ইচ্ছেটা ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

মাহমুদা খাতুন স্নাতক সম্পন্ন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের ছয় মাসের সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন। তখন বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা আরও তীব্র হয়। বইয়ের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থাকায় অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেননি। পড়াশোনা সম্পন্ন করে ১৯৭৬ সালের ২৮ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে যোগ দেন তিনি। সেখানে দীর্ঘ চার দশক কাজ করেছেন। লাইব্রেরিতে কাজ করার সুবাদে বইয়ের সঙ্গে তার আত্মিক বন্ধন হয়েছে আরও সুদৃঢ়।

২০১৭ সালের ৩০ জুন ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদ থেকে অবসরে গ্রহণ করেন মাহমুদা খাতুন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বইয়ের প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরিতে ৪১ বছর কাজ করেছি। দিন দিন লাইব্রেরির প্রতি প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল, যদি কখনো সম্ভব হয় একটি পাবলিক লাইব্রেরি করব। সেই ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। তারপর চাকরি থেকে অবসরের পর আমি যখন রিটায়ারমেন্টের টাকা পেলাম, তখন আমি সেই টাকার পুরোটা ব্যয় করে আমার বাড়ির চারতলায় একটি লাইব্রেরি করেছি। যেখানে আমাকে সহযোগিতা করেছে আমার দুই ছেলে, তানভীর অপু ও তারেক অণু।’

মাহমুদা খাতুনের ছোট ছেলে তারেক অণু বলেন, ‘আমাদের এরকম একটি লাইব্রেরি করা দরকার, যেখানে অন্য মানুষ এসে বই পড়তে পারবে। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে পারবে। লাইব্রেরি থেকে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে তরুণরা যে উন্নত জীবনবোধের চর্চা করবে সেখানেই আমাদের স্বার্থকতা।’

প্রান্তিক অঞ্চলে যেখানে লাইব্রেরি নেই, নন-একাডেমিক বই পড়ার সুযোগ নেই বললেই চলে, সেসব অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের বই পড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের জন্য কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে মাহমুদা খাতুন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এরকম বড় পরিসরে লাইব্রেরি করতে না পারলেও প্রান্তিক অঞ্চলের বইপ্রেমীরা যেন নিজ উদ্যোগে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বইপড়ুয়াদের নন-একাডেমিক বই পড়ার সুযোগ করে দিতে পারে, এ ব্যাপারে আমি যথাসম্ভব উৎসাহ দিয়ে থাকি।’

লাইব্রেরি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? আপনার লাইব্রেরি কি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি লাইব্রেরির কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করার পর তা সবার পড়ার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে চাই। এখানে বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান অর্জন করবে। তবেই আমার সব প্রচেষ্টা স্বার্থক হবে।’

আপনার সংগ্রহে তরুণ লেখকদের বই আছে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তরুণরা ভালো লিখছেন। আমার এখানে তাদের বই রয়েছে। সমসাময়িক বই থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় সাহিত্যের বিভিন্ন গল্প উপন্যাসসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্লভ সব বই সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে আমার ছেলেরা। এসব বই আমি লাইব্রেরিতে সাজিয়ে রেখেছি।’

নতুন প্রজন্মকে বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তুলতে কী কী উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘নতুন প্রজন্মকে বইপড়ুয়া হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের মধ্যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা বোধ তৈরি করতে হবে। একাডেমিক বই পড়ার পাশাপাশি তাদের নন-একাডেমিক বই পড়ায় উৎসাহ জোগাতে হবে। নন-একাডেমিক বই পড়ায় যে সময় নষ্ট হয় না, তা তাদের বোঝাতে হবে। জ্ঞানের বিভিন্ন সেক্টর সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে। ছেলেমেয়েরা জ্ঞানপিপাসু হলে বইয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। তাদের জীবনবোধ উন্নত হবে।’

মাহমুদা খাতুন বলেন, ‘২০১৭ সালের আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই পড়ার ভিড় জমে যেত। শিক্ষার্থীদের জায়গা দেওয়া যেত না।  কিন্তু এখন দৃশ্যপট পুরো পাল্টে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতির কারণে ঘরে বসেই কম্পিউটারে, মোবাইলে ই-বুক পড়ছে মানুষ।’

ই-বুক ও অডিও বুকের প্রভাবে হার্ডকপির বই কি অদূর ভবিষ্যতে খুব বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন হবে? এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ই-বুক ও অডিও বুকের মাধ্যমে বই পড়ার যে প্রকৃত তৃষ্ণা, তা পুরোপুরি মিটে বলে আমার মনে হয় না। সাজিয়ে রাখা তাক থেকে বই নামিয়ে তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে পড়ার যে আনন্দ তা ই-বুক পড়ে পাওয়া যায় না। ই-বুক, অডিও বুক জরুরি মুহূর্তে পড়া যায় বা শোনা যায়, তবে তা কখনোই হার্ডকপি বইয়ের চাহিদা মেটাতে পারবে না।’

অবসরের সব অর্থ দিয়ে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বইয়ের প্রতি যে ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন মাহমুদা খাতুন, তা খুব প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ‘পৃথিবী বইয়ের হোক। ছেলেমেয়েরা ছোট থেকেই বই পড়ার মাধ্যমে ঘর থেকে জ্ঞান অর্জন করে বড় হোক। বই পড়ার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার আন্দোলন সবার মাঝেই ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।’

জাহ্নবী

অদম্য আইভীর গল্প

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:২৭ পিএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৫ পিএম
অদম্য আইভীর গল্প
জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী

তিনি একই সঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক। এ ছাড়া প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের একজন কর্মী। এই তিনি হলেন জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী; যিনি পোড়া ক্ষতের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছেন। তিনি সবার জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ২০২৩ সালে বিবিসির বিশ্বের সেরা ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় ওঠে আসে জান্নাতুল ফেরদৌস আইভীর নাম। তিনি একজন বার্ন সারভাইভার। ১৯৯৭ সালে রান্না করার সময় তার ওড়নায় আগুন লাগে। তখন শরীরের ৬০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এতে কুঁচকে বিকৃত হয় মুখ ও শরীরের কিছু অংশ। এ পর্যন্ত চামড়া প্রতিস্থাপনসহ তার শরীরে প্রায় ৫০ বার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এরপরও তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, লিখেছেন বই। পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠান জন্য কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।

খুলনায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা জান্নাতুলের পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জে। ২০১৩ সালে তার বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে তিনি রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন। জান্নাতুল ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ২০০৫ সালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১০ সালে ব্র্যাক থেকে এলএলবি ডিগ্রি এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সে ডিপ্লোমা লাভ করেন।

শুধু তাই নয়; চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন কোর্সও করেছেন জান্নাতুল। তিনি পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন তিনটি। এ পর্যন্ত তার লেখা ১১টি বই প্রকাশিত হয়েছে। শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে যারা জীবনযাপন করেন, তাদের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিজের জীবনের গল্প বলে থাকেন তিনি। তিনি তার গল্প বলার সহজাত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে চারপাশের মানুষের মাঝে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ মানুষদের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করেন।

পোড়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা নারীদের চলার পথ যে মসৃণ নয়, সেটা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই পদে পদে জেনেছেন আইভী। নিজের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ও তৃণমূল গবেষণায় জেনেছেন, শুধু প্রতিবন্ধী বলে কম দেওয়া হয় বেতন। আরও নানা বাধা থাকে তাদের জীবনে। এসব দূর করতেই আইভী ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অলাভজনক সংস্থা ‘ভয়েস অ্যান্ড ভিউজ’। দগ্ধ প্রতিবন্ধীরা যাতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়, তা নিয়ে কাজ করছেন তারা। কারণ, বর্তমান আইনে এ ধরনের মানুষদের কথা ভাবা হয়নি। তাই তারা বঞ্চনার মধ্যেই থেকে যান বলে মনে করেন ভয়েস অ্যান্ড ভিউজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী। দগ্ধ শরীরের কারণে বিভিন্ন সময় নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে।

নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে বিয়ে করেননি জান্নাতুল। এই সমাজে বিয়ে না করে একা থাকার এ সাহস জুগিয়েছেন তার মা। মা সবসময় বলে এসেছেন, শুধু সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়ে করার প্রয়োজন নেই। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন তাকে অনেক কটু কথা শোনালেও সবসময় তিনি পাশে পেয়েছেন তার পরিবারকে। তার মা তাকে বোঝা মনে না করে অন্যান্য সন্তানের মতোই আগলে রেখেছেন। যার ফলস্বরূপ, তিনি আজ সফল একজন নারী।

জান্নাতুল ফেরদৌস আইভী স্বপ্ন দেখেন, এ দেশে একদিন প্রতিবন্ধীরা গণপরিবহনে চলতে গিয়ে কটু কথা শুনবে না। ভবনের নকশা অনুমোদনেও প্রতিবন্ধী মানুষটির কথা মাথায় রাখা হবে। রাষ্ট্র যাতে এসব বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে- নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে এসব নিয়ে সহায়তামূলক কাজও করবেন বলে তার ইচ্ছে রয়েছে। 

জাহ্নবী

প্রথম নারী শাসক রাজিয়া সুলতানা

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:২৫ পিএম
প্রথম নারী শাসক রাজিয়া সুলতানা

দেশ শাসনের দায়িত্বভার একজন নারীর কাছে, এখন এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আরও হাজার বছর আগে একজন নারী সিংহাসনে বসছেন এবং দেশ পরিচালনা করছেন এটা মোটেই কোনো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। বলছি ভারতবর্ষের প্রথম নারী শাসক রাজিয়া সুলতানার কথা। রাজিয়ার প্রকৃত নাম ছিল রাজিয়া উদ দুনিয়া ওয়া উদ্দিন। তার জন্ম ১২০৫ সালে। ইলতুৎমিসের কন্যা ছিলেন রাজিয়া। একাধারে একজন ভালো শাসক ও সেনাপতি হওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তার দক্ষতা ছিল অনন্য।

সেই আমলে ভারতে মেয়েদের কোনো রাজনীতি করার কোনো অধিকার ছিল না। শৃঙ্খল ভেঙে প্রথমবার শাসক হয়েছিলেন রাজিয়া সুলতানা। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মেধাবী, পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন রাজিয়া। শুধু তাই নয়, রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। যুদ্ধের প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা। পিতা ইলতুৎমিশ নিজ হাতে তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়েছিলেন, সঙ্গে রাজনীতিও। মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সাহসিকতা ও যুদ্ধনৈপুণ্যে কৈশোরেই নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। তারুণ্যে তিনি নেতৃত্ব ও শাসকসুলভ দক্ষতায় পিতার আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। সময়টা ১২৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দ। রাজিয়া সুলতানার পিতা ইলতুৎমিস যখন গোয়ালিয়রে অভিযানে ব্যস্ত ছিলেন, তখন তিনি দিল্লি শাসনের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সময় তার বয়স ছিল ২৫ বছর। তিনি এত দক্ষতার সঙ্গে দিল্লির শাসনভার সামাল দিয়েছিলেন যে, তার পিতার অনুপস্থিতির সুযোগ কেউ নিতে পারেনি। সুলতান তখন থেকেই মেয়েটার প্রতি অসম্ভব মুগ্ধ এবং আশাবাদী। সুলতানের বড় পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পিতার জীবদ্দশায় ইন্তেকাল করেন। ইলতুৎমিশ তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করে যান। কিন্তু তার মৃত্যুর পর একজন নারীর শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান দরবারের অভিজাতরা। আর তাই ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তারা তার ছোট পুত্র রাজিয়ার সৎভাই রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতায় বসান। রোকনউদ্দীন ফিরোজ ছিলেন চরম অযোগ্য একজন শাসক। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, রাজ্য চালনার চেয়ে গায়িকা আর নর্তকীদের সঙ্গে সময় কাটাতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আর এই সুযোগে রাজ্য চালাতে লাগলেন তার মা তুরকান খাতুন। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। অযোগ্য শাসক রোকনউদ্দীন আর তার অনভিজ্ঞ মা তুরকান খাতুনের জন্য গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নেমে এল। এরপর অভিজাতদের কাউন্সিল তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন এবং রাজিয়া সুলতানা সিংহাসনে আরোহণ করেন।

নারী হিসেবে যেন কেউ তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে না দেখেন, সেজন্য সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতেন পুরুষদের অনুকরণে আলখাল্লা পরে। মাথায় পরতেন পাগড়ি। তিনি তাকে সুলতানা সম্বোধন করাটাও পছন্দ করতেন না। কারণ তার মতে সুলতানা হচ্ছে সুলতান অর্থাৎ শাসকের স্ত্রীর উপাধি। তিনি তো আর শাসকের স্ত্রী নন, বরং স্বয়ং একজন শাসক। তার শাসনকালে নিজের নামে মুদ্রা বের করেছিলেন তিনি।

পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন নারী অসম্ভব দক্ষতা এবং অসীম দৃঢ়তায় সব প্রতিকূলতা জয় করে অন্ধকার যুগে জ্বালিয়েছিলেন সাহসিকতার মশাল। ১২৩৬ সালের এই ঘটনায় শুধুই পাক-ভারত এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ইতিহাস নয়, পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে একজন রমণীর এমন বিস্ময়কর উত্থান আজও অমলিন। রাজিয়া তার সময়ে জনগণের জন্য অনেক স্কুল, গবেষণাকেন্দ্র, লাইব্রেরি বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে সময় দিল্লির সর্বত্র তুর্কিদের প্রভাব প্রতিপত্তি থাকায় সুলতানা রাজিয়াকে সবাই নিরঙ্কুশভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তারপরও সব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে প্রায় চার বছর ধরে গোটা সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন রাজিয়া সুলতানা। অবশেষে ১২৪০ সালের ১৫ অক্টোবর একটি যুদ্ধে তিনি মারা যান।

জাহ্নবী

বিশ্ব মাতাচ্ছে ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:২৪ পিএম
বিশ্ব মাতাচ্ছে ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’

সময়টা ২০১৪ সাল। বিশ্বের অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ার তিন তরুণীর হাতে জন্ম নেয় নতুন এক বিস্ময়কর অধ্যায়। মাথায় হিজাব আর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক পরে দাপটে গিটার আর ড্রাম বাজিয়ে গান গেয়ে পথচলা শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ার তিন তরুণীর। তাদের পরিচয় হয় এক ইসলামিক স্কুলে। পড়াশোনার পাশাপাশি ইসলামিক সংগীত এবং পপ সংগীত গাইতেন তারা।

‘ভয়েস অব বেসপ্রট’ নামে একটি ব্যান্ডের জন্ম দেন তারা, যার ভোকালিস্ট বিদি রাহমাওয়াতি (২৩) ও ফিরদা মারসিয়া কুর্নিয়া (২৪) এবং ড্রাম বাজান ইইউএস সিতি আইশাহ (২৪)। ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’-এর অর্থ ‘কোলাহল’। দলটি ইংরেজির পাশাপাশি সুদানিজ ভাষায়ও গান করে। ইন্দোনেশিয়ার এই তিন তরুণী কেবল গান করেন তাই নয়, বরং তারা সংগীত নিয়ে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভাঙার চেষ্টা করছেন। তারা প্রমাণ করতে চান, মুসলিম নারীরা হিজাব পরেও মেটাল বাজাতে পারেন। ভোকালিস্ট বিদির মতে, তাদের গ্রামে মেটাল মানেই শয়তানের কাজ। এটা মেয়েদের জন্য নয়, বিশেষ করে হিজাব পরা নারীদের। এমনকি বিদির পরিবার একবার ইসলামী আচারের মাধ্যমে এক ধরনের চিকিৎসা করিয়ে তার মেটাল সংগীতের ভূত দূর করতে চেয়েছিল। দল গড়ার পর শুরুতে তাদের মনে হতো তাদের কোনো বাড়িঘর বা ঠিকানা নেই; যেন তারা কোনো অপরাধী, কোনো উদ্বাস্তু। একটা সময় গিয়ে আমেরিকার শ্রোতারাও তাদের জঙ্গি বলেছিল। গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট কুর্নিয়ার মতে, নারীরা দুর্বল এবং ঢালাওভাবে মুসলমানরা জঙ্গি এসব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতেই তারা গান করেন। তাদের এই ব্যান্ড নারীদের ক্ষমতায়নের জন্যই গান করে বলে তিনি মনে করেন। কুর্নিয়া বলেন, ‘আমরা নারীরা হিজাব পরি আর আমাদের গান নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে।’ তিনি চান তাদের সবাই কাজের মাধ্যমে চিনুক, চেহারার জন্য নয়।

মেটালের প্রতি এই তিন তরুণীর অনুরাগ জন্মায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিস্টেম অব অ্যা ডাউন’ নামের এক ব্যান্ডের ‘টক্সিসিটি’ অ্যালবাম শোনার পর। স্কুলের গাইডেন্স কাউন্সিলর তাদের মেটালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

অল্প কিছুদিনের মধ্যে তারা ‘মাইটি আইল্যান্ড’ নামের নতুন অ্যালবাম নিয়ে কাজ শুরু করবেন। এই অ্যালবামের গানগুলো ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি নিয়ে কথা বলবে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন দলের ভোকালিস্ট কুর্নিয়া। তিনি বলেন, ‘নিজেদের গ্রামের উঠতি মিউজিশিয়ানদের জন্য একটি কমিউনিটি গড়ে তুলতে চাই আমরা।’ কুর্নিয়ার মতে তারা তাদের কমিউনিটির ক্ষমতায়ন করতে চায়।

‘ভয়েস অব বেসপ্রট’ সর্বপ্রথম ২০১৮ সালে VOB জাকার্তাভিত্তিক বুকিং এজেন্সি অ্যামিটি এশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সময়ে তারা তাদের প্রথম একক গান ‘স্কুল বিপ্লব’ প্রকাশ করে। এই একক গানটি ব্যান্ডের আকর্ষণ অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং এরপরই তারা আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসবে পারফর্ম করার জন্য অনেক আমন্ত্রণ পায়। ব্যান্ডটি ইতোমধ্যে ২০২২ সালে অনুগেরাহ মিউজিক ইন্দোনেশিয়া পুরস্কার জিতেছে এবং ২০২৩ সালে এ পুরস্কারের জন্যই মনোনীত হয়েছে।

গত ২৮ জুন সংগীতের অন্যতম মঞ্চ গ্লাস্টনবারির কনসার্টে গিটার ও ড্রামের সঙ্গে গান গেয়ে কোলাহল তুলেছেন এই ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’ ব্যান্ডটি। জাভার হাইস্কুল পড়ুয়া তিন কিশোরী যখন কাঁচা হাতে মেটাল মিউজিক তৈরি করেছিলেন, তখন তারা ভাবতেও পারেননি যে মাত্র এক দশকের মাথায় তারা ইংল্যান্ডের গ্লাস্টনবারি উৎসব মাতাবেন!

জাহ্নবী

দেশে নারী মাদকাসক্ত বাড়ছে!

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:০৭ পিএম
আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:০৮ পিএম
দেশে নারী মাদকাসক্ত বাড়ছে!
অলংকরণ: নাজমুল আলম মাসুম

দেশে পুরুষের পাশাপাশি নারী মাদকসেবীর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে এ সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের বিষয়টি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সমাজে তা একসময় ভয়ংকর রূপ নেবে। সামাজিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অধিকাংশ নারী মাদকাসক্তই পাচ্ছেন না যথাযথ চিকিৎসা। সামাজিক লোকলজ্জার কারণে নারী মাদকসেবীরা চিকিৎসা গ্রহণে অনাগ্রহী। একসময় পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন তারা। আর এ সুযোগটি নিচ্ছে মাদক কারবারিরা। পরিবার বিচ্ছিন্ন মাদকাসক্ত নারীদের তারা ব্যবহার করছে মাদক পাচারের কাজে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশন কাজ করছে নারী মাদকাসক্তদের নিয়ে। সংস্থাটির আছে একটি নারী মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। এর ‘হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ’ বিভাগের প্রধান ইকবাল মাসুদ এক গণমাধ্যমে বলেন, ‘স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাদকে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ পারিবারিক অবহেলা। বিশেষ করে তারা বাবা-মায়ের কাছ থেকে যথাযথ সময় পায় না। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।’

সম্প্রতি এক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬৪৭ নারীকে মাদক থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি মানসিক ব্যাধি ও আচরণবিষয়ক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২৯ রোগী পুনরায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারী নারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ ইয়াবা, ২৮ শতাংশ গাঁজা, ১৬ শতাংশ ঘুমের ওষুধ ও ১৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের মাদক গ্রহণকারী। মানসিক রোগের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া ৩৪ শতাংশ, মুড ডিজঅর্ডার ৩০ শতাংশ, বাইপোলার ১২ শতাংশ, ডিপ্রেশন ১০ শতাংশ, ওসিডিতে ৬ শতাংশ ও বাকিরা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

মাদকাসক্ত নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া গৃহবধূ থেকে শুরু করে সব বয়সী নারীই আছেন এর মধ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, টিনেজ মেয়েদের মধ্যে মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান কারণ পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক না থাকা, বাবা-মায়ের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়া। আবার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গও অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদক নিরাময় কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার মতে, ‘দেশে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ হতে পারে তাদের দিয়ে মাদক পাচার করানো। সুকৌশলে আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিরা নারীদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এতে দুই দিক দিয়ে লাভবান হচ্ছে তারা। প্রথমত, তাদের মাদকের ক্রেতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মাদকাসক্ত এই নারীদেরই তারা ব্যবহার করতে পারছে মাদক পাচারের কাজে। কারণ নারীদের দিয়ে মাদক পরিবহন পুরুষদের তুলনায় নিরাপদ।’

সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. দেলোয়ারা বেগম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারীরা যেহেতু সন্তান প্রসব করেন, তাই একজন মাদকাসক্ত নারী এ ক্ষেত্রে তার নিজের ও সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের নারীদের অনেকেরই গর্ভপাত হয়ে যায়। আবার অপুষ্ট কিংবা কখনো বিকলাঙ্গ সন্তানও জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

মনোবিদদের মতে, অন্য অনেক কারণের সঙ্গে সবার মধ্যে থেকেও একাকিত্ব নারীর মাদকাসক্তির কারণ। এজন্য পরিবারকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বন্ধুদের চাপ, একাকিত্ব, পরিবারের অন্য সদস্য বা বন্ধুবান্ধবের মাদক গ্রহণ, বিষণ্নতা, হতাশা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, অভিভাবকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বিচ্ছেদ, সন্তানকে সময় না দেওয়ার প্রবণতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

শুধু মাদক নয়, নারীদের মধ্যে তামাক সেবনের হারও বাড়ছে বলে জানা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৪৩ শতাংশ মানুষ তামাকে (সিগারেট, বিড়ি, সাদা পাতা, জর্দা) আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশই নারী।

ছয় বছর আগে জাতিসংঘের এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৬৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ পুরুষ আর নারী ১৩ শতাংশ। মাদকাসক্ত নারীদের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

অন্যদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দেশে ৪০ লাখ মাদকাসক্তের মধ্যে ৪ লাখ নারী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কিশোর ও তরুণ, ৪৫ শতাংশ বেকার, ৬৫ শতাংশ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং ১৫ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত।

আবার বাংলাদেশ মাদকবিরোধী সংস্থা (মানস)-এর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখ। এর মধ্যে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৬ শতাংশ। মানসের ওই পরিসংখ্যানে আরও উল্লেখ করা হয়, পাঁচ বছর আগে নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিল ৫ শতাংশ।

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২০ দশমিক ৬ শতাংশ।

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের মতে, নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় মূল বাধা হচ্ছে তার পরিবার। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে চিকিৎসার ব্যাপারে পরিবার কোনো সহযোগিতা করে না। অন্যদিকে, পরিবারের সদস্যদের অনাগ্রহের পাশাপাশি মাদকাসক্ত নারী নিজেও চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহী নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদক গ্রহণের পর শরীর যখন আর সহ্য করতে পারে না এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শুরু করেন, তখন নারীরা চিকিৎসা নেন।

মাদকাসক্ত নারী যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মাদক কারবারে জড়িত নারীর সংখ্যাও। তালিকায় শীর্ষে থাকা মরণনেশা ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তারে নারী ও শিশুদের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। মাদক কারবারিরা ইয়াবার আমদানি, সরবরাহ ও কেনাবেচার জন্য নিরাপদ হিসেবে নারী ও শিশুদের বেছে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা ব্যর্থ হওয়ায় তাদের পরিবার ও ভাড়া করা নারী-শিশুদের নামাচ্ছে এ ব্যবসায়। একজন নারী মাদক কারবারি তার চুলের খোঁপায় প্রায় ৬০টি ইয়াবা বহন করতে পারে। একইভাবে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে শিশুদের স্কুল ব্যাগেও পাচার করা হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবার ছোট-বড় চালান।

এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, দেশে যেকোনো ধরনের অপরাধের তুলনায় মাদকের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় নারীর। মাদকের সঙ্গে নারীর এই জড়িয়ে পড়ার কারণ বহুবিধ হলেও মূলত নারীর সামাজিক অবস্থান ও অসহায়ত্ব এটির মূল কারণ। নানাভাবেই নারী বৈষম্যের শিকার, সেটি যেমন পারিবারিকভাবে, তেমনি সামাজিকভাবেও। এই বৈষম্য তাদের ভেতর যে হতাশা আর ক্ষোভের জন্ম দেয় তা থেকে তারা মাদক গ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়া দেখা যায় কখনো নারী মাদক গ্রহণ করছে তার স্বামীর কারণে। একইভাবে মাদক কারবারিতে জড়িয়ে পড়ছে তার স্বামীর কারণে। নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নারীকে ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক কারবারিতে।

গণমাধ্যমে মাদকের কুফল নিয়ে অনেক বেশি প্রচার-প্রচারণা, স্কুল-কলেজে বিভিন্ন সময়ে মাদকবিরোধী সেমিনারের আয়োজন করা, সন্তানের ব্যাপারে বাবা-মায়ের নিয়মিত খোঁজখবর রাখার মাধ্যমে নারীদের মাদকে আসক্তির ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব।

জাহ্নবী