![বাংলার প্রথম নারী প্রকৌশলী ইলা মজুমদার](uploads/2024/06/12/a2-1718171301.jpg)
শুধু পুরুষরাই নয়, মেয়েরাও যে সবক্ষেত্রে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারেন তিনি তার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। বলছিলাম, হাজারও বাঙালি মেয়ের স্বপ্নপূরণের পথিকৃৎ বাংলার প্রথম নারী প্রকৌশলী ইলা মজুমদারের কথা। যার জন্ম ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই ফরিদপুর জেলায়। বাবা যতীন্দ্র কুমার মজুমদার। পেশায় তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা ছিলেন গৃহিণী। ইলার সব কাজে সমর্থন দিতেন তার বাবা যতীন্দ্র কুমার। মাত্র ১২ বছর বয়সে সাইকেল এবং ১৬ বছর বয়সে জিপ চালানো শিখে ইলা তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সবাইকে অবাক করে দেন। বাবার চাকরির সুবাদে ইলা মজুমদার বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। নবম শ্রেণি পর্যন্ত খুলনায় পড়াশোনা করার পর ১৯৪৫ সালে ইলা মজুমদার এবং তার পরিবার ধর্মীয় উত্তেজনার কারণে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেই ১৯৪৬ সালে তিনি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে মেট্রিক পাস করেন। পরবর্তী সময়ে আশুতোষ কলেজ থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
ছোটবেলা থেকেই কারিগরি বিদ্যায় প্রবল আগ্রহ ছিল ইলা মজুমদারের। ১৯৪৭ সালে তৎকালীন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি নারীদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিংসহ শিক্ষার সব ক্ষেত্রে পড়ার দরজা খুলে দেন। ইলা মজুমদার ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং দুটি বিষয়েই পড়ার সুযোগ পেলেও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বেছে নেন এবং বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। সে সময় তার সহপাঠী হিসেবে ছিলেন আরেকজন মেয়ে, অজন্তা গুহ, কিন্তু তিনি এক বছর পরে বাদ পড়ে যান। তখন কলেজে ভারতীয় এবং ইউরোপিয়ান মিলিয়ে আট শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। যাদের মধ্যে ভারতবর্ষের প্রথম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একমাত্র ছাত্রী ছিলেন ইলা মজুমদার।
পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্নাতকের পর স্নাতকোত্তর স্তরে পড়াশোনার জন্য ইলা মজুমদার স্কটল্যান্ডে যান এবং সেখানকার ‘বার অ্যান্ড স্টাইড’ সংস্থা থেকে স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা নেন। পরে ভারতে ফেরেন ইলা মজুমদার দেরাদুনের ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি’-এর ভারী যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে ছয় মাস চাকরি করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি দিল্লি পলিটেকনিক কলেজে প্রভাষক হন। এর মধ্যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর দুটি বই ‘অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পলস’ এবং ‘হাইড্রলিক্স থ্রু ওয়ার্কড একজাম্পলস’ প্রকাশ করেন।
১৯৫৯ সালে ইলা মজুমদার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং এরপর তিনি ‘মজুমদার’ পদবীর বদলে ‘ঘোষ’ পদবী গ্রহণ করেন। বিয়ের পরপরই ইলা কলকাতায় চলে আসেন এবং সেখানে ‘ইনস্টিটিউট অব জুট টেকনোলজি’তে লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর তার উদ্যোগে কলকাতার গড়িয়াহাট রোডে বাংলার প্রথম মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (Women’s Polytechnic College, Kolkata) প্রতিষ্ঠা হয়। সেখানে তিনি প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। তার বিস্তৃত এই কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ সালে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে তাদের প্রকল্পে ঢাকাতেও একটি মহিলা পলিটেকনিক কলেজ খোলার দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। পরে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে অনুষ্ঠিত নারী প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেন।
তিনি তার কর্মজীবনে যে লিঙ্গবৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন, সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমি অবশ্যই আমার পেশাগত জীবনে সব সময় লিঙ্গবৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছি। আমার মনে হয়েছে সমাজের মানসিকতা বদলাতে অনেক সময় লাগবে এবং তা সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।’ ব্যক্তিগত জীবনে ইলা মজুমদারের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে হলেও সেই মেয়ের অকালমৃত্যু হয়। এই মহীয়সী নারী ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর মারা যান।
জাহ্নবী