ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া সৈয়দ আমানুল্লাহর বাড়ি খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়নে। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আমানুল্লাহ পরিচয়দানকারী ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, আনারকে খুনের জন্য আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গে তার ৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়।
আর এই আমানুল্লাহই হলেন খুলনা অঞ্চলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী শিমুল ভূঁইয়া। খুলনার ফুলতলা এলাকায় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা শিমুল ভূঁইয়া নামে পরিচিত। তবে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশের কাছে শিমুল ভূঁইয়া নিজেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পরিচয় দেন। তিনি আমানুল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছেন, সেই পাসপোর্টে তিনি কলকাতায় গেছেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করিয়েছেন। কীভাবে তিনি শিমুল ভূঁইয়া থেকে আমানুল্লাহ হলেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন, এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, ফুলতলার দামোদর হাইস্কুলে পড়ার সময় শিমুল ভূঁইয়ার নাম ছিল ফজল মোহাম্মদ ভূঁইয়া। তার বাবার নাম ছিল নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া। পরবর্তী সময়ে অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ধূম্রজাল তৈরি করে তিনি ২০১৯ সালে ঢাকা থেকে সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পাসপোর্টটি করেন। সেই পাসপোর্টে তিনি ভারতের কলকাতায় গিয়েছিলেন। শিমুলের ভাই শিপলু ভূঁইয়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তিনি ভুয়া তথ্য দিয়ে নাম পরিবর্তন, এনআইডি ও পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কলকাতার নিউ টাউনের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে সংসদ সদস্যকে খুন করে ১৫ মে দেশে ফেরেন আমানুল্লাহ পরিচয় দেওয়া শিমুল ভূঁইয়া। পরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেন আনোয়ারুলকে তারা হত্যা করেছেন। আনারকে হত্যার জন্য আনোয়ারুলের বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সঙ্গে তার চুক্তি হয়। আনোয়ারুলের সঙ্গে আক্তারুজ্জামানের স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথ্য পাচ্ছে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজীমকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আমানুল্লাহ নামে পরিচয়দানকারী শিমুল ভূঁইয়া।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, শিমুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে খুনসহ অন্তত দুই ডজন মামলা আছে। গণেশ নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে যশোরের অভয়নগর থানার এক মামলায় আমানুল্লাহ সাত বছর (১৯৯১-৯৭) জেল খাটেন। ইমান আলী নামের এক ব্যক্তিকে খুনের ঘটনায় ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন।
এদিকে ২০০০ সালে শিমুল ভূঁইয়া পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে জবানবন্দিতে চরমপন্থি দলের অস্ত্র কোথায় কার কাছে রয়েছে জানান। এর মধ্যে খুলনার ওয়ার্ড কমিশনার যুবলীগ নেতা এস এম আসাদুজ্জামান লিটুর নাম ছিল। বিষয়টি নিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হলে ক্ষিপ্ত হন লিটু। পরে ২০০০ সালের ১৬ জুলাই সাংবাদিক শামছুর রহমানকে তার যশোরের অফিসে ঢুকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলায় লিটু আসামি ছিলেন। ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট ক্রসফায়ারে লিটু মারা যান। ২০১৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া।
অন্যদিকে ছদ্মবেশী খুনি শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীন খুলনা জেলা পরিষদ সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত। ২০১৭ সালের ২৫ মে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে খুন হন ফুলতলা উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু। ২০১৮ সালে শিমুল ভূঁইয়াকে তালিকায় প্রথম ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমীনকে চতুর্থ নম্বরে অভিযুক্ত করে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দেয়। কিন্তু পুলিশের খাতায় দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর সর্বশেষ ২০২২ সালে খুলনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাবিনা ইয়াসমীন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য নির্বাচিত হন।
জিজ্ঞাসাবাদ-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই খুনের বিভিন্ন পর্যায়ে চরমপন্থি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা রয়েছেন। শিমুল ভূঁইয়াকে যিনি ভাড়া করেছেন, সেই আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা ডা. মিজানুর রহমান ওরফে টুটুলের আত্মীয়। মিজানুর রহমান ২০০৮ সালে পুলিশের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
খুলনায় খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের মো. আসাদুজ্জামান কাটু মিয়ার ছোট ছেলে। তাদের বাড়ি কোটচাঁদপুর শহরের মাছবাজার এলাকায়। তার বড় ভাই মো. সহিদুজ্জামান ওরফে সেলিম কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র। আক্তারুজ্জামান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কিছুদিন চাকরি করে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। তবে এলাকার কেউ তার ব্যবসা সম্পর্কে পরিষ্কার কিছু জানেন না।
আমানুল্লাহর পরিবার লাপাত্তা
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ফুলতলার দামোদর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়া ও তার ভাইপো তানভীর ভূঁইয়ার বাড়ি তালাবদ্ধ। শিমুল ভূঁইয়ার ভাই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শিপলু ভূঁইয়ার বাড়িও লোকশূন্য। আমানুল্লাহ যশোরের অভয়নগরে চরমপন্থি গণেশ হত্যা মামলায় সাত বছর (১৯৯১-৯৭) ও ইমান আলী হত্যা মামলায় ১৩ বছর (২০০০-১৩) জেল খাটেন।