তখন আমি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে ন্যাপ (ভাসানী) বানারীপাড়া উপজেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলাম। ৭ মার্চের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হই। সেখান থেকে এসে আমরা বানারীপাড়ার কয়েকজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী একত্র হই। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পরই মুসলিম লীগের তৎকালীন নেতা আক্কাস খানের নেতৃত্বে নরেরকাঠি এবং গাভা গ্রামের ৭৬ জন নর-নারীকে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। পরে তাদের নরেরকাঠি নামক সমদ্দার বাড়ির খালের মধ্যে ফেলে রাখে।
আমি তখন উপজেলার গাভা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনা দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ২৫ মার্চের পর রাজ্জাকপুরের মরহুম মোসলেম মল্লিকের বাড়িতে বসে মুক্তিবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে কেশব চন্দ্র দাস, হায়দার আলী খাঁ, এনায়েত হোসেন, বিমল কৃষ্ণ দাস, মানিক, মজিবুর রহমান, গোলাম সালেহ মঞ্জু মোল্লাসহ বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলি। নাম দেওয়া হয় আমার নামে ‘বেণু’ বাহিনী। এর কয়েক দিন পর আমাদের বাহিনীতে যুক্ত হন তৎকালীন দৈনিক সংবাদের সাংবাদিক ও দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার।
ওই সময়ে স্থানীয় কয়েকজনের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি। টিমের সদস্যরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আলতা, গাভা, রামচরণপুর, রাণীর বাড়ি, বাইশারি, সৈয়দকাঠি এলাকায় কর্মী সংগ্রহের কাজ শুরু করি। কয়েক দিনের মধ্যে আলতা রানির বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি করা হয়। সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করি।
প্রশিক্ষণ বলতে প্রথম ছিল শারীরিক ব্যায়াম। কয়েক দিন পর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গাভা বিল্বাড়ির তৎকালীন ডাকাত সর্দার আব্দুল মান্নান ওরেফে মনা ডাকাতের কাছে যাই। ভয় দেখিয়ে তার কাছে থাকা একটি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে আসি। তখন পর্যন্ত আমরা কেউ রাইফেল চালাতে জানতাম না। একদিন সংবাদ পাই যুদ্ধে ঝামেলা এড়াতে আর্মির একজন ল্যান্স নায়েক নিজ বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এই সংবাদ পেয়ে আমি দলবল নিয়ে ল্যান্স নায়েক লোকমানের কাছে চলে যাই। তাকে বাধ্য করি আমাদের রাইফেল চালানো শেখাতে। এরপর আমরা স্থানীয়ভাবে কয়েকটি রাইফেল সংগ্রহ করি এবং গাভা স্কুলে ক্যাম্প গঠন করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ওই এলাকার লোকজনই আমাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করতেন।
৯ নং সেক্টর কমান্ডের অধীনে আমাকে বরিশালের বানারীপাড়া, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়ন, ছারছিনা দরবার শরিফ, ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাভা-রামচন্দ্রপুর ইউনিয়ন ও উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের বেস কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মেজর এম এ জলিল আমাকে কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন। তখন আমাদের দলে একমাত্র মহিলা মুক্তিযোদ্ধা শাহানারা পারভীন শোভা যোগদান করেন।
পর্যায়ক্রমে আমাদের দলে কম করে হলেও প্রায় ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বর্তমান বানারীপাড়ার ভূমি অফিসে ইপিআর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পরে গঠন করা হয় রাজাকার বাহিনী। এতে রজ্জব আলী ছিল পিস কমিটির দায়িত্বে, শান্তি কমিটির দায়িত্বে ছিল ডা. সাইজউদ্দিন তালুকদার, আব্দুর রব মৃধা, মলঙ্গা গ্রামের রব হাফেজ, আনোয়ার তালুকদার, আব্দুল খালেক, গেরদে আলী ও শহীদুল হক।
তাদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী স্থানীয় আওয়ামী লীগপন্থিদের বাড়ি ঘরে হামলা চালায়। তাদের ধরে এনে বিভিন্ন রকম হয়রানি করে। তাদের ঘরবাড়ির মালামাল লুটপাট করে। কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয়। সেখানে চলে বন্দিদের নির্যাতন। কয়েকজন রাজাকার আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্য ওই ক্যাম্পে মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যেত।
এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় পাকবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। তার মধ্যে ছিল জম্বুদীপে মিলিটারি গানবোট আক্রমণ, পার্শ্ববর্তী থানার ছারছিনার পীরের বাড়ির ক্যাম্পে যৌথ আক্রমণে অংশগ্রহণ, পেয়ারা বাগানে একাধিকবার আক্রমণ, বানারীপাড়া থানা দখল।
এর মধ্যে ছারছিনার পীরের বাড়ি আক্রমণ এবং বানারীপাড়া থানা দখল ছিল স্মরণীয়। সম্ভবত ২২ নভেম্বরের ঘটনা। তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন স্বরূপকাঠির কমান্ডার জাহাঙ্গীর বাহাদুর। তিনি ছারছিনার দরবার শরিফে পাকিস্তানি ঘাঁটিতে আক্রমণের বিষয়ে সহযোগিতা চাইলেন। আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। তবে ছারছিনা দরবার শরিফ আক্রমণ করতে যে পরিমাণ গোলাবারুদের দরকার তা আমাদের সংগ্রহে ছিল না। আমি তাকে গোলাবারুদ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। এ সময়ে তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সাব-কমান্ডার নূর মোহাম্মদ হাওলাদার ।
কথা অনুযায়ী রাত ৮টার দিকে বানারীপাড়ার বাকপুরের কাজী মতিয়ার রহমানকে (মতি কাজী) ওই অপারেশনের টিমপ্রধান করে আমি, অনুকূল, হাবিব, দেলোয়ারসহ ৩০-৩৫ জন রওনা হই। রাতে স্বরূপকাঠির সংগীতকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থান করি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ছারছিনা দরবার শরিফের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আমরা এবং জাহাঙ্গীর বাহাদুরের দল দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে আক্রমণ করি। সারা রাত যুদ্ধ হয়। দরবার শরিফের চারদিকে অবস্থান নিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য ভাগে ভাগে বিশ্রামে যাই। মতি কাজী পীরের বাড়ির পেছনে একটি কলাবাগানে বিশ্রামের জন্য বসেছিলেন।
এ সময়ে নিরস্ত্র মতি কাজীকে পীরের বাড়ি থেকে আলবদর বাহিনী গুলি করে। পরে তাকে ওই বাড়ি ভেতরে নিয়ে যায়। এ খবর পেয়ে আমরা আবার সকালে আক্রমণ করি। কিন্তু আমাদের গোলাবারুদ শেষ হওয়ায় ফিরে আসতে হয়েছিল। এর পর থেকে মতি কাজীকে আর পাওয়া যায়নি। মতিকে ফেরত পেতে তার বাবা মোশারাফ কাজী ছারছিনার পীরের হাত-পা ধরে মাফও চেয়েছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি।
পরে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) সোর্স থেকে শুনতে পাই মতি কাজীকে কেটে টুকরা টুকরা করে সন্ধ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মতি কাজীকে নয়, এ রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে ছারছিনা দরবার শরিফে হত্যা করে লাশ সন্ধ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেয় পাকবাহিনী ।
যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনা যেমন আমাকে আনন্দিত করে, তেমনি মতি কাজী ও বিমলের লাশ না পাওয়ার বেদনা থেকে যাবে আমৃত্যু। সেই সঙ্গে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি রাজাকার, আলবদর, আলসামস, শান্তি কমিটি, পিস কমিটির লোকজন এবং তাদের সন্তানদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্যালুট দেন দেখে। ৩০ লাখ মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে, আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি কি এই দৃশ্য দেখার জন্য? কয়েক লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন কি এর জন্য? আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করেছে, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিচ্ছে। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার অনাহারে দিন কাটায়। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরা ও তাদের সন্তানরা অট্টালিকা গড়ে তোলে। এই কষ্ট, এই বেদনা প্রকাশের কোনো ভাষা নেই।
বেনীলাল দাশ গুপ্ত, বেস কামান্ডার, বানারীপাড়া, বরিশাল
অনুলিখন: মঈনুল ইসলাম সবুজ, বরিশাল প্রতিনিধি