মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পটভূমিকায় মার্চ মাসে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উন্নীত হয়। দীর্ঘদিনের বেদনা, বৈষম্য, নির্যাতন, শোষণ, লাঞ্ছনা প্রভৃতি সহ্য করতে করতে বাঙালি প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস করে দাঁড়াবার শক্তি জোগাতে, মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করার তাড়না প্রদানে, পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রত্যয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল। মহান মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে ৭ মার্চের জগদ্বিখ্যাত ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি জাতির সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা, সংগ্রাম করে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে যাবতীয় কলাকৌশল, শত্রুকে পদদলিত করতে মুক্তিকামী জনতাকে আহ্বান জানানোর দীপ্ত মন্ত্রে অনুপ্রেরণা জোগাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে এবং মুক্তিপাগল জাতি বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হেঁটে স্বাধীনতার আজন্ম লালিত স্বাদকে আস্বাদন করেছে।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মূল্যায়ন বেশ তাৎপর্যময় ও অর্থবহ। তিনি লিখেছেন- ‘বর্তমান যুগের ইতিহাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম একটি বিরাট ঘটনা। …সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে, এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিবের বিশাল মহিমার একটি প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই, তাঁর মহানুভবতায় আর একটি পরিচয় আমরা পাই তাঁর চিন্তাধারার অসাধারণতায়।’ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু গৃহীত প্রত্যেকটি পদক্ষেপই উল্লেখযোগ্য এবং জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়েছে বিধায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সহজ হয়েছে।
হাসনাত আবদুল হাই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেটিকে ঐতিহাসিক বক্তৃতা বলা হলে যথেষ্ট হবে না। সে বক্তৃতা ছিল পৃথিবীতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তৃতা। ভাষার শক্তিতে, আবেগের স্ফূরণে এবং বক্তব্যের শানিত ক্ষুরধারে ৭ই মার্চের বক্তৃতা ছিল অসাধারণ এবং অদ্বিতীয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে কোনো রাজনীতিবিদ বা গণনায়ক কখনো এমন বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে তেজোদীপ্ত ভাষায় এবং সময়োপযোগী করে বক্তৃতা দিয়েছেন- তার উদাহরণ নেই।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের যে আবেদন ও মর্মার্থ সেটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে।
মফিদুল হক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ওপর আলোচনায় লিখেন- ‘ব্যতিক্রমী লেখক আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুকে বলতেন বাংলার ভীম, মধ্যযুগের বাংলার লোকায়ত যে নেতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন রাজ্যপাট, নির্মাণ করেছিলেন মাটির দুর্গ, ভিতরগড়ে যে দুর্গ প্রাচীর এখনও দেখতে পাওয়া যায়, মাটির হলেও পাথরের মতো শক্ত। বাংলার ইতিহাসের এমন অনন্য নির্মাণকীর্তির তুলনীয় আর কিছু যদি আমাদের খুঁজতে হয়, তবে বলতে হবে ৭ই মার্চের ভাষণের কথা। যেমন ছিল মধ্যযুগের বাংলার রাজা ভীমের গড়া পাথরের মতো শক্ত মাটির দুর্গ, তেমনি রয়েছে বিশ শতকের বাংলার লোকনেতা মুজিবের ভাষণ, যেন-বা মাটি দিয়ে গড়া, তবে পাথরের মতো শক্ত।’
আবুল মোমেন উল্লেখ করেন- ‘সাতই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে একটি জাতির জন্ম হয়েছে, আর সেই জাতি একজন অবিসংবাদী নেতাকে পেয়েছে। মুক্তিপাগল যে জাতি স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে অধীর প্রতীক্ষায় ছিল তারা এই ভাষণের মাধ্যমে সেই সংকেতটি পেয়েছিল। এই ভাষণ ঘরকুনো নিতান্ত ছাপোষা বাঙালিকে রূপান্তরিত করেছিল বীরের জাতিতে। সর্বোচ্চ ত্যাগে অকুণ্ঠিত চিত্তে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছে তাদের। এই ভাষণের পরে যে কারও মনের সামান্য দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দূর হয়ে গেল। স্বভাবত বিভক্ত, কলহপ্রিয় মানুষগুলো সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা পেল এ থেকে। এই ঐক্য কোন সীমা মানেনি, জাত মানেনি- সকল বাংলা ভাষাভাষীকে এক করে দিয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবন, সংসার, পরিবার, নিজেদের নৈমিত্তিক কাজগুলোকে বড্ড ছোট অকিঞ্চিৎকর মনে হতে থাকল। এই একটি ভাষণ সবার অন্তরের রুদ্ধ কপাটগুলো খুলে দিয়ে সকল ক্ষুদ্র ভাবনা দূর করে তাদের নিয়ে এলো জাতীয় জীবনের ঘটমান ইতিহাসের মহা রণাঙ্গনে। হঠাৎ করে ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা ভুলে সবাই বড় হয়ে উঠল, মহৎ কাজের প্রেরণায় সবাই উজ্জীবিত।’
সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন তাঁর লেখনিতে বলেন- ‘৭ই মার্চ অপরাহ্ণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, তখন লক্ষ লক্ষ লোকের বিশাল জনসমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার তুলনা যেন ইতিহাসের কোথাও নেই। পেরিক্লিস, আব্রাহাম লিংকন এবং অন্যান্য মহৎ জাতীয় নেতা ও রাষ্ট্রনায়কগণ যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন, তা কোনো জনসমুদ্রে (কেবল লুথার কিং এর বক্তৃতাটি ছাড়া, তাও দশ লক্ষ লোকের সামনে নয়) দাঁড়িয়ে নয়, সেসব ভাষণে কোনো একটা জাতিকে হাজার বছরের শৃঙ্খল ভেঙ্গে পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে, মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে বাঙালি যেন হঠাৎ করে তার হাজার বছরের জড়তা, দৈন্য ও গ্লানি অতিক্রম করে এক মহাচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আজন্ম সাধন-ধন, আজন্ম-অধরা স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত দীক্ষা পেল।’ উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনন্য ও অদ্বিতীয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ তার লেখনিতে তুলে ধরেন এভাবে- ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোনাল্ড রিগান পর্যন্ত ২৫০০ বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field, We Shall Fight on The Beaches: The Speeches That Inspired History শিরোনামে একটি গ্রন্থ লেখেন, যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত। এতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, জুলিয়াস সিজার, অলিভার ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, জোসেফে গ্যারিবোল্ডি, আব্রাহাম লিংকন, ভ্লাদিমির লেনিন, উইড্রো উইলসন, উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট, চার্লস দ্য গল, মাওসেতুং, হো চি মিন প্রমুখের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।’ বিশ্ব পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সঙ্গে তুলনার বিচারে ভাষণটি বাঙালির ঐতিহ্য এবং সব রাজনীতিবিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল।
উপরোক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণের সূত্রপাত এই অর্থে করা হয়েছে, উল্লিখিত ব্যক্তিগণ প্রত্যেকেই গুণীজন এবং বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চায় অভিজ্ঞ এবং স্ব স্ব জায়গায় প্রণিধানযোগ্য। দেশে-বিদেশে তাদের কাজের স্বীকৃতি রয়েছে এবং ইতিহাসকে যদি আপনি জানতে চান, বুঝতে জান, ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান করতে চান তাহলেই অবশ্যই তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সে কারণেই ৭ মার্চের বিষয়বস্তু ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মর্মার্থকে একটি ইতিবাচক প্ল্যাটফরমে আলোচনার লক্ষ্যেই বিশেষজ্ঞদের মতামতকে হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। লেখনি তথা বক্তব্যে মূলত এটাই প্রতীয়মান হয়, রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ঐতিহাসিকতা রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত উঁচুমার্গীয় ও বাস্তবধর্মী সেটি মূলত ১৮ মিনিটের অলিখিত ভাষণ থেকে আলোকপাত করা যায় এবং বোধগম্য হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করবার অপরিসীম দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। কেননা ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রায়োগিক বিশ্লেষণে এবং বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘ সময়ের শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে মোক্ষম জবাব হিসেবে ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালির জীবনমানসে একটি অনন্যশৈলী সংযোজন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়