কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য জনসমক্ষে আসার পর সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
রবিবার (৩০ জুলাই) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক খবরের কাগজকে বলেছেন, ব্যক্তির দায় সরকার কোনোভাবেই বহন করবে না। যারা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছেন। এ অবস্থায় আতঙ্কে রয়েছেন মন্ত্রী-এমপিরাও।
জানা গেছে, তাদের অনেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র দাবি করেছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই তার নিজস্ব মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন, তথ্য সংগ্রহ করছেন।
বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ‘পাবলিক পারসেপশন’ রয়েছে, এমন কর্মকর্তা ও মন্ত্রী-এমপিদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন তিনি।
ঘনিষ্ঠদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারও ব্যক্তিগত দুর্নীতির জন্য সরকারের ভাবমূর্তি খারাপ হোক- তা হতে দেবেন না তিনি।
সূত্রমতে, দুর্নীতির বিষয়ে সাম্প্রতিক কালে গণমাধ্যমে উঠে আসা চিত্র দেখে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই বিব্রত হয়েছেন।
ঘরোয়া আলোচনায় তাদের কেউ কেউ বলছেন, এভাবে দেশ চলতে পারে না। সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইতিবাচক পরামর্শ দিয়েছেন। এর পরই প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান জানান দিয়ে বক্তৃতা করছেন।
সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। সে যে-ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, ধরা হবে।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার বলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কারও ছাড় নেই। আমি সবার উদ্দেশে বলছি, বাড়াবাড়ি করবেন না। ক্ষমতার দাপট কেউ দেখাবেন না। কাউকে ক্ষমা করা হবে না। এটা শেখের (শেখ মুজিবুর রহমানের) বেটি। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দেখিয়ে দেবেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি কতটা কঠোর হতে পারেন।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের দলের সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার রয়েছেন। তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। আর এ কারণেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।’
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন এমপি রবিবার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে বদলি কোনো কার্যকর শাস্তি হতে পারে না। বরং দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পদের সঠিক হিসাব বের করতে হবে এবং তার সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রি করে দেওয়া দরকার। অবশ্যই তাকে তড়িৎবেগে চাকরিচ্যুত করতে হবে। বদলি কোনো শাস্তি হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, সরকারি চাকরিজীবীর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ও সম্পদ হচ্ছে তার চাকরিটি। দুর্নীতিপরায়ণরা জনগণের শত্রু, দেশের শত্রু।’
সম্প্রতি সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সদস্য মতিউর রহমান, প্রথম সচিব (কর) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের দুই ভাইসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে এবং সম্পদ জব্দ ও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়।
দুদক একের পর এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে তাদের বিপুল সম্পদ জব্দ ও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এতে একদিকে যেমন দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে প্রশংসিত হচ্ছে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান।
সরকারের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র খবরের কাগজকে জানিয়েছে, গত সরকারের (টানা তৃতীয় মেয়াদের) শুরুর দিকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং থানা-পুলিশের মাধ্যমে মন্ত্রী-এমপিদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই ধারা অব্যাহত না থাকলেও নিজস্ব মাধ্যমে মন্ত্রী-এমপিদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা এসব তথ্যের ভিত্তিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করেন তিনি। টানা চতুর্থ মেয়াদের সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের আগে সংগ্রহ করা তথ্য কাজে লাগান প্রধানমন্ত্রী। আর সে কারণেই আগের সরকারের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী বাদ পড়েন, এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যও রয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চিত্র গণমাধ্যমে আসার পর সংশ্লিষ্টরা নড়েচড়ে বসেছেন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আবার বিপুল উদ্যমে শুরু করেছে তথ্য সংগ্রহ। তারা সচিবালয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের খোঁজখবর রাখছে। এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তরে কারা আসছেন- তাদের সঙ্গে সম্পর্ক কী, এসব দর্শনার্থী কী কাজ নিয়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দপ্তরে ঘুরছেন- সেই খোঁজখবরও নিচ্ছেন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন।
সরকারের এক প্রতিমন্ত্রীর দুর্নীতিসংক্রান্ত একটি সংবাদ গণমাধ্যমে আসার পর তার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী বর্তমানে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন। খবরের কাগজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রতিমন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠজন।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনি এলাকার পাশাপাশি ঢাকায় প্রতিমন্ত্রীর বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এমনকি সচিবালয়ে তার (প্রতিমন্ত্রীর) দপ্তরেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনকে দেখা যাচ্ছে। তারা এলাকা থেকে আসা নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব গতকাল রবিবার খবরের কাগজের এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা এসেছে তার মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ফাইল যেন ভালোভাবে পড়ে-দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারলে তা-ও সরকারের উচ্চপর্যায়কে জানাতে বলা হয়েছে।