![জলাবদ্ধতায় অচলপ্রায় শিল্প-কলকারখানা](uploads/2024/05/18/Gazipur-1716007344.jpg)
গাজীপুরের ভাওয়ালগড় ইউনিয়নের বানিয়ারচালা-ভবানীপুর গ্রামে পানি নিষ্কাশনের একমাত্র সিংদীঘি খালটি দখল, দূষণ আর অব্যবস্থাপনার কারণে ভরাট হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে ওই এলাকার রাস্তাঘাট। পানি ঢুকে পড়ছে বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানায়। ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কৃষিসংশ্লিষ্টরা। চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন কয়েকটি কারখানার প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিকসহ দুই গ্রামের ৫০ হাজার বাসিন্দা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পূর্ব বানিয়ারচালা-ভবানীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিংদীঘি (স্থানীয়ভাবে প্রচলিত নাম) খালটি লবণদহ নদীতে গিয়ে পড়েছে। এটি প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ। অপরিকল্পিত ড্রেনেজব্যবস্থার কারণে মাঝের কিছু অংশ বেদখল হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় গণহারে ময়লা ফেলায় হয়ে গেছে ভরাট। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের পশ্চিম পাশে অবস্থিত আবুল কাশেমের নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরির বর্জ্য ও মাটি দ্বারা খালটি প্রায় ভরাট। রোডের আরেক অংশ কালভার্টের পূর্ব পাশে ময়লা ফেলার স্তূপ তৈরি করা হয়েছে।
এ ছাড়া রোডের পশ্চিম পাশে প্যারাগন গ্রুপের সিমটেক্স লিমিটেডের ভেতর দিয়ে অবস্থিত ড্রেন ভরাট করে শুধু পাইপের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টি হলেই পানি আর বের হতে পারে না। বৃষ্টির সময় উজানের পানি নেমে পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
পানি নিষ্কাশনের একমাত্র বানিয়ারচালা-ভবানীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সিংদীঘি খাল সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন এলাকার বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসী। কয়েক বছর ধরে বারবার আবেদন করা হলেও এখনো কারও সাড়া মেলেনি। ফলে দিন দিন আরও নাজুক হয়ে পড়েছে খালটি। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে খুবই বেহাল দশা এটির। ফলে আসন্ন বর্ষা মৌসুমের দুর্ভোগ নিয়ে শঙ্কিত-উদ্বিগ্ন ভুক্তভোগীরা।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতির বিষয়ে গত বছরের ৯ অক্টোবর জয়দেবপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। জিডি করেন বিজি কালেকশন লিমিটেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাসিমুল হাসান কচি। গত বছরের ৫ অক্টোবর বৃষ্টিতে এলাকায় তিন থেকে চার ফুট পানি বৃদ্ধি পায়। ফলে শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাটির নিচতলায় পানি প্রবেশ করে। মেশিনপত্রসহ বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল, সুতা, কাপড়, রপ্তানিযোগ্য তৈরি পোশাক ও অ্যাকসেসরিজ নষ্ট হয়। এতে বিজি কালেকশন লিমিটেডের প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যমানের সম্পদের ক্ষতি হয়। শুধু বিজি কালেকশনই নয়, এতে আরও কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
পানি নিষ্কাশন ও ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য দুই বছর ধরে সরকারি বিভিন্ন মহলকে অনুরোধ জানায় বিজি কালেকশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ২০২২ সালের ২১ জুন গাজীপুর জেলা প্রশাসক, গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ভাওয়ালগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, গাজীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সুপারকে লিখিতভাবে জানানো হয়। একই বছরের ৪ জুলাই শ্রীপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল সহকারী পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত আবেদন করে সংস্থাটি। কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় পুনরায় চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি গাজীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ২২ জানুয়রি গাজীপুর জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ বলেন, ‘পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রেখেই বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যে কারণে বন্ধ হয়ে গেছে খালের পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। তার পরও যতটুকু ছিল, তাও বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে ফেলেছে। ফলে ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি হলেই এলাকা তলিয়ে যায়। বাড়িঘর, জমির ফসল নষ্ট হয়, মাছ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা জানিয়েছি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত কেউই গ্রহণ করেননি।’
বিজি কারখানার অডিট ও অ্যাকাউন্টস বিভাগের এজিএম মো. ইনামুল হক বলেন, ‘এই এলাকার একমাত্র পানি নিষ্কাশনের খালটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কালভার্টের নিচে ময়লা ফেলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। গত দুই বছরে নিজস্ব অর্থায়নে সিটি করপোরেশন থেকে গাড়ি এনে কয়েকবার আমরা খালটি পরিষ্কার করেছি। প্রতিবার চার-পাঁচ লাখ টাকা খরচ পড়ে। কিন্তু নতুন করে আবার ময়লা ফেলা হয়। গাজীপুরের ডিসিসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিলেও আজও সুরাহা মেলেনি।’
বানিয়ারচালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সরকার বলেন, ‘এলাকার লোকজন নিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে দুবার খালটি পরিষ্কার করেছি। রাতে-দিনে পাহারা দেওয়ার জন্য পাহারাদার বসানো হয়েছে। কিন্তু ভোররাতে বিভিন্ন কোম্পানি ট্রাকে করে ময়লা এনে ফেলে চলে যায়। ময়লা ও জলাবদ্ধতার যন্ত্রণায় এলাকার মানুষজন অতিষ্ঠ।’
গাজীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল হক বলেন, ‘আমি এখনো চিঠি পাইনি। চিঠি পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অভিযোগের চিঠি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি খাল হলে পানি নিষ্কাশনে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিবন্ধকতা কেউ সৃষ্টি করতে পারবে না। এলাকাবাসীর জনদুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনে প্রজেক্ট নিয়ে সমস্যার সমাধান করা হবে।’