![সেবামূলক পেশা নার্সিংয়ে নারীরাই এগিয়ে](uploads/2024/05/15/a1-1715756462.jpg)
দিনের পর দিন অসীম ধৈর্য নিয়ে পাশে থেকে, সেবা করে যারা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন তারাই সেবিকা। সেবা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। জনসেবা, সমাজসেবা, মানবসেবা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি। কিন্তু একজন সেবিকার সেবা মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে তা খুব ধৈর্যেরও কাজ। ডাক্তারের চেয়ে সেবিকার সেবা কোনো অংশে কম নয়। সাধারণত নারীরাই এ পেশায় যুক্ত থাকেন বেশি। বাংলাদেশে নার্সিং পেশায় থাকাদের ৯০ ভাগই নারী। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর বলছে, নারী জাতি মমতাময়ী, এজন্যই তাদের সেবার মহান এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আধুনিক নার্সিং পেশার অগ্রদূত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নিজেও মনে করতেন, নার্সিংটা মেয়েদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তাই তিনি নার্সিংয়ের প্রাথমিক শিক্ষাটা শুধুমাত্র নারীদের জন্যই শুরু করেছিলেন।
জনসংখ্যা অনুপাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নার্স ঘাটতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে যে পরিমাণ সেবক বা সেবিকা দরকার, বরারবরই তার ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা নার্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি ইসমত আরা পারভীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে নার্স আছেন মাত্র ৬জন; যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকমেন্ডশন ২৩ জন। সরকারি হাসপাতালে নার্সের ৪৫ হাজার ৯৬৫টি পদ (সেবা ও শিক্ষা) থাকলেও কর্মরত রয়েছেন ৪১ হাজার ৯৬১ জন (৯ম ও ১০ম গ্রেড সহ)। এখনও বাংলাদেশে ২ লক্ষ নার্স ঘাটতি রয়েছে’। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে নার্সিং খাতে অবশ্যই নজর দিতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে অব্যবস্থাপনা থাকলে কখনোই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাতে উন্নয়ন সম্ভব নয়।
তাই নার্সদের জন্য উপযোগী কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। অনেক সময়ই নারী নার্সরা বুলিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। রোগী কিংবা রোগীর আত্মীয়স্বজনের কটু কথার শিকার হন তারা। কর্মস্থলে নারী নার্সদের জন্য অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি এবং তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। বেশিরভাগ হাসপাতালেই খাবার রুম, ড্রেসিং রুম, ওয়াশ রুমের পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা থাকে না। এতে নারী নার্সদের সমস্যা হয়।
জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বাইরে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা যাবে না। নার্সিংয়ের কাজটি খুব ধৈর্যের সঙ্গে করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীদের সেবা করা, সামলানোর দায়িত্ব পালন করা, তাদের মন উৎফুল্ল রাখার চেষ্টা করা, তাদের নানাবিধ উপদেশ দেওয়া- এসব করতে করতে নার্সরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। যদি তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হন, তাহলে তাদের মন-মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, তারা ধৈর্য হারাতে পারে; যা রোগী ও নার্স উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ইসমত আরা পারভীন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে নার্সদের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বর্তমানে অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে সুযোগ সুবিধা আরও বাড়াতে হবে এবং শিক্ষকদের বিষয় অনুযায়ী পদ তৈরি করা জরুরি। এছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে জার্নাল ক্লাব থাকা খুবই দরকার’।
আর এসবের আগে প্রয়োজন নার্সিং শিক্ষা খাতের অব্যবস্থাপনা নির্মূল করা। নার্সিং কারিকুলামকে ঢেলে সাজাতে হবে। বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল ডিজিএনএমএসের সহযোগিতায় দক্ষ নার্স ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ কারিকুলাম কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। বেতন বাড়াতে হবে। পদোন্নতি না হলে, বেতন বৃদ্ধি না পেলে তারা হতাশায় ভুগতে থাকেন। যদিও দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নার্স থেকে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও সুপারিনটেনডেন্ট এবং নার্সিং ট্রেনিং কলেজের প্রশিক্ষক হওয়ার সুযোগ আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। অনেক হাসপাতালেই ট্রেনিং বিহীন ভুয়া নার্স দিয়ে সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। এসব নিবন্ধনবিহীন নার্সদের জন্য রোগীদের ভুক্তভোগী হতে হয়। নার্সিং খাতে উন্নয়ন করতে চাইলে সরকারকে সরকারি, বেসরকারি সবদিকেই সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
এ ছাড়া নার্সদেরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া খুব জরুরি। না হলে এই মহান পেশা তার সৌন্দর্য হারাবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নার্সরা রোগীদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে কাগজপত্র, ফাইল লেখালেখি করে, যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র দেখাশোনা করে এবং অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। আর এখন তো সময় কাটানোর অনেক মাধ্যম আছে। ফেসবুক, টিকটক, ওটিটি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সময় ব্যয় করে থাকেন তারা।
রাজধানী শহরের একটি স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে থাকা এক রোগীর আত্মীয় অভিযোগ করেন, সেখানের আইসিইউতে দায়িত্বরত নার্সরা ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ ছাড়া অন্য নার্স বা সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করে সময় কাটান। অথচ তাদের উচিত সবসময় রোগীদের ওপর খেয়াল রাখা। কেননা আইসিইউতে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ রোগীরাই থাকেন, তাদের সঙ্গে কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতে পারেন না, শুধু রোজ এক থেকে দুবার ভিজিটিং আওয়ারে তারা দেখা করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে একজন রোগীর সব প্রয়োজন দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়ে নার্সের ওপর। কিন্তু তারাই যদি এমন দায়িত্বহীন আচরণ করেন, তাহলে তা রোগীর জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া অনেক নার্সেরই আচরণ ভালো থাকে না। রোজ রোগীর সেবা করতে করতে হয়তো তারা বিরক্ত হয়ে যান। কিন্তু এ পেশায় তো ধৈর্য রাখতেই হবে।
নার্সিং পেশার উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে এবং নারীদের জন্য নিরাপদ ও উপযোগী কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে চাইলে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যেমন দরকার, তেমনই নার্সদেরও আরও ধৈর্যশীল ও নিবেদিতপ্রাণ হওয়াটা জরুরি।
জাহ্নবী