বাজারে প্রতি কেজি চিনির খুচরা দর ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। পাইকারি দর ১০৪ টাকা। সিলেটে আলোচিত ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি সরকারি নিলাম ডাকে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে কিনেছেন নিলাম ডাকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়া। প্রতি কেজি ১২৫ টাকা দর হাঁকিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে চিনি কিনেছেন তিনি। এই দরের সঙ্গে ভ্যাট ও ট্যাক্স যুক্ত হয়ে প্রতি কেজির দাম পড়ছে ১৪২ টাকা। বাজার দরের চেয়ে প্রতি কেজিতে ২২ থেকে ২৭ টাকা বেশি। এত দাম দিয়ে চিনি কেনার পেছনে কী কারণ?
এমন প্রশ্ন নিলাম ডাকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীসহ নিলাম প্রত্যক্ষ করা ব্যবসায়ীদের। এ ব্যাপারে গিয়াস অবশ্য বলছেন, নিলামে অংশ নিয়ে তিনি ‘জোশের ঠেলায়’ বেশি দাম বলে ফেলেছেন। গিয়াস ‘জোশের ঠেলায়’ বললেও নেপথ্যে রয়েছে আরেক ধান্দা। চিনি ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিলামে কেনা চিনির কাগজপত্র দেখিয়ে চোরাচালানের আরও চিনি বৈধ করতেই অধিক দাম দিয়ে চিনি কিনেছেন তিনি।
সর্বোচ্চ দরদাতা গিয়াস মিয়া সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার লতিফপুরের বাসিন্দা। সিলেট মহানগরীর কালীঘাট বাণিজ্যিক এলাকায় তার ‘রুহেল ট্রেডার্স’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাজার দরের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে চিনি কেন কিনলেন? এমন প্রশ্নে নিলামের দিন তিনি খবরের কাগজকে বলেছিলেন, ‘জোশের ঠেলায় বেশি দাম হেঁকে ফেলেছি!’ গিয়াসের ‘জোশের ঠেলার’ পেছনে কারণ ‘চোরাই পথে চিনি চোরাচালানির পন্থা’ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে অবহিত হয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে ও বিকেলে কয়েকদফা ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। কালীঘাটে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) জালালাবাদ থানার উমাইরগাঁওয়ে গত ৬ জুন ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় পরদিন পুলিশের এসআই মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে জালালাবাদ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। সিলেটে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে সীমান্ত পথে অবৈধভাবে আনা চিনি চোরাচালানের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে বড় চালান। পুলিশ হেফাজতে থাকা ১৪ ট্রাক চিনি ১ কোটি ৪২ লাখ টাকায় বিক্রির সরকারি নিলাম ডাক সম্পন্ন হয় গত বুধবার (৩ জুলাই) বিকেলে। সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর হাকিম (তৃতীয় আদালত) উম্মে হাবিবার আদালতে প্রকাশ্য নিলামে চিনি বিক্রি করা হয়।
সরকারি নিলাম কমিটির সভাপতি ও সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আব্দুল মুমিনসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যের উপস্থিতিতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের অষ্টম তলায় প্রকাশ্যে নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। জব্দকৃত ১ লাখ ৫ হাজার ৭০০ কেজি চিনির মধ্যে মামলার আলামত হিসেবে ৫ কেজি চিনি আদালতে সংরক্ষণ করে বাকি ১ লাখ ৫ হাজার ৬৯৫ কেজি চিনি নিলামে দেওয়া হয়। নিলামের বিট লিস্টে সর্বমোট ৭০ জন নাম তালিকাভুক্ত করেন।
সকলের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য ওই নিলামে ব্যবসায়ী মো. গিয়াস মিয়া প্রতি কেজি চিনির দাম ১২৫ টাকা ডাক দেন। এই ডাক সর্বোচ্চ হওয়ায় গিয়াসই ক্রেতা মনোনীত হন। মোট টাকার সাড়ে সাত পার্সেন্ট ভ্যাটও দিতে হবে তাকে। চিনির মোট দাম ১ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার ৮৭৫ টাকা। ভ্যাটসহ দাম পড়েছে ১ কোটি ৪২ লাখ ২ হাজার ৭৬৬ টাকা।
জালালাবাদ থানার ওসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিলামের ক্রেতা চিনির মূল ব্যাংকে জমা দিয়ে কাগজপত্র নিয়ে এলে তার কাছে চিনি হস্তান্তর করা হবে। নিলাম ডাকের তিন কার্য দিবসের মধ্যে মালামাল হস্তান্তর করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।’
এদিকে প্রায় ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা লোকসান দিয়ে ব্যবসায়ী গিয়াস মিয়া চিনি কেনায় বিরূপ মন্তব্য করছেন অন্যান্য ব্যবসায়ী। তারা বলছেন, লোকসান দিয়ে তিনি শুধু চিনিই কেনেননি। তিনি চিনির সঙ্গে কিনেছেন নিলামের বৈধ কাগজ। এই বৈধ কাগজ দিয়ে তিনি এখন অবৈধ আরও চিনি বাজারজাত করবেন। তাই তিনি এখানে লোকসান দেখালেও তার লাভের খাতা ঠিকই পূর্ণ থাকবে।
এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) এডিসি মিডিয়া মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘চিনিগুলো নিলাম হয়েছে, এখনো হস্তান্তর হয়নি। চিনিগুলো বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে এক ব্যবসায়ী কিনেছেন। এটা নিয়েও দুই ধরনের আলোচনা করছে দুটি পক্ষ। একপক্ষ বলছে, এই নিলামের কাগজ নিয়ে ব্যবসায়ী আরও অবৈধ চিনি আনবেন। আবার যারা চিনি অধিক মূল্যে কিনেছেন, তারা বলছেন বাজারে চিনির একটি সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়েছে। ওই সিন্ডিকেট ভাঙতে বেশি দামে চিনি কেনা হয়েছে। তবে যে যাই বলুক, এই নিলামের চিনি ব্যবসায়ী সরাসরি তার গোডাউনে নিয়ে যাবেন। এই নিলামের কাগজ তিনি সড়কে ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে যেহেতু এই বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তাই আমাদের নজরদারি এখন আরও বাড়বে। আমরা আমাদের ফোর্সকে বলে দেব এ ধরনের কোনো কাগজ কেউ প্রদর্শন করলে যেন তারা ভালোভাবে যাচাই করেন।’