![ভারতের মাথাব্যথা হেড](uploads/2023/11/21/1700551379.Head-India-Niloy=OK.jpg)
ষষ্ঠ শিরোপা উঁচিয়ে ধরা অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে ভারতকে সামনে পাওয়া নতুন কিছু নয়, সেটা আগেই ক্রিকেট বিশ্বকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন মিচেল স্টার্ক। যুগ যুগ ধরে ক্রিকেটের সঙ্গেই যাদের বসবাস তারাও জানেন স্টার্ক সেদিন কি বুঝিয়েছিলেন। প্রবীণ ক্রিকেট সমর্থকরা প্রথমেই টেনে আনবেন জোহনসবার্গের ফাইনাল। ২০০৩ বিশ্বকাপের সেই ফাইনালে ভারতকে ১২৫ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয় শিরোপা জেতার উৎসবে মেতেছিল অজিরা। মাঝে আরও দুটি বিশ্বকাপ জেতা অজিরা যে হেক্সা মিশন সেই পুরোনো প্রতিপক্ষ ভারতকে বধ করেই সফল করতে চেয়েছিল তা আর কে জানত! এবারও উড়তে থাকা ভারতকে ফাইনালে হারাল ৬ উইকেটের বড় ব্যবধানে।
স্টার্ক সেদিন ফাইনালের পুরোনো অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিয়ে বিশেষভাবে সামনে এনেছিলেন পাঁচ মাস আগের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের স্মৃতি। যে ফাইনালে স্টার্ক নিজেও ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডে। সে স্কোয়াডেরই একজন ট্রাভিস হেড। ২৯ বছর বয়সী ব্যাটার হেডই ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে যান বিশ্বকাপ ফাইনালে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়েও হেডের কাছেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতের বোলিং লাইনআপসহ গোটা টিম। আহমেদাবাদের নীল সাগরের ঢেউয়ে ভাটা হয়ে এসেছিলেন ট্রাভিস হেড। চাপের মুখে তার ১৩৭ রানের অনবদ্য ইনিংসেই ভারতের স্বপ্নের সমাধি হয়েছে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে।
৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া যখন নীল সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়, তখন দক্ষ নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ট্রাভিস হেড। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা হেডের ব্যাটকে থামাতে কোনো কৌশলই কাজে লাগেনি রোহিত শর্মার বোলারদের। এদিন যেন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের স্মৃতিকে জাগ্রত করে তুলেছিলেন হেড। ওভালের সেই ফাইনালেও ম্যাচসেরা হয়েছিলেন হেড। প্রথম ইনিংসে তার ১৬৩ রানে ওপর ভর করেই ৪৬৯ রানের বড় পুঁজি পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। যে ফাইনাল ২০৯ রানের বিশাল ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা ঘরে তুলেছিল অজিরা।
পরপর দুবার ট্রাভিস হেডের ব্যাটের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হলো ভারতকে। অথচ বাঁ হাতি এই ব্যাটারের বিশ্বকাপে হলুদ জার্সিতে মাঠে নামা নিয়েই ছিল অনিশ্চয়তা। বিশ্বকাপের আগে সেপ্টেম্বরে সেঞ্চুরিয়ানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইনজুরিতে পড়েন তিনি। বিশ্বকাপের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার পরেও সেরে ওঠার ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা না থাকার পরও তাকে বিবেচনায় রেখেই বিশ্বকাপে ১৫ সদস্যের দল ঘোষণা করে অস্ট্রেলিয়া। ইনজুরি সারিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। সেখানেই দেন আস্থার প্রতিদান। ধর্মশালায় প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে উদ্বোধনী জুটি গড়েছিলেন ১৭৫ রানের। ৬৭ বলে ১০৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।
চাপ সামাল দেওয়ার এক বিশেষ ক্ষমতা আছে হেডের। দুই ফাইনালেই দ্রুত তিন উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে চেপে ধরেছিল ভারত। স্মিথকে সঙ্গী করে সেই পরিস্থিতি থেকে অস্ট্রেলিয়াকে টেনে তুলেন ২৮৫ রানের জুটিতে। হেডের ১৬৩ রানের ইনিংসের পাশাপাশি স্মিথও খেলেছিলেন ১২১ রানের ইনিংস। কিন্তু আহমেদাবাদের ট্রাভিসের ভুলের খেসারত দিতে হয়েছিল স্মিথকে। ননস্ট্রাইক প্রান্তে থেকেও বুঝতে ভুল করেছিলেন স্মিথের এলবিডব্লিউ হওয়া বলটার ইমপ্যাক্ট। তার পরামর্শেই রিভিউ না নিয়ে মাত্র ৪ রানে ফিরে যান স্মিথ। স্মিথের বিদায়ে ৪৭ রানে ৩ উইকেটে পরিণত হয় অস্ট্রেলিয়া। বড় স্ক্রিনে আউটের রিপ্লে দেখার পর হেডসহ হতাশায় পুড়েছে পুরো অস্ট্রেলিয়ার সাজঘর। অবশ্য এমন ভুলের পরও ঘাবড়ে যাননি তিনি। রীতিমতো শাসন করেছেন ভারতীয় বোলারদের। মারনাস লাবুশানকে সঙ্গে নিয়ে ১৯২ রানের জুটি গড়ে। ম্যাচের চাহিদানুযায়ী লাবুশানের ১১০ বলে অপরাজিত ৫৮ রানের দায়িত্বশীল ইনিংসটি মনে করিয়ে দিয়েছিল টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্মিথের ইনিংসকেই।
মারনাসের ইনিংসই সাহস জুগিয়েছিল হেডকে। ম্যাচশেষে এমনটাই বলেছিলেন হেড, ‘এটা অসাধারণ একটা দিন। আমিও খুবই রোমাঞ্চিত। ইনজুরিতে ঘরে সোফায় বসে খেলা দেখার চাইতে এটা অনেক ভালো। আমি কিছুটা নার্ভাস ছিলাম কিন্তু মারনাস অসাধারণভাবে খেলেছে এবং সব চাপে পানি ঢেলে দিয়েছে।’
ভারতের পরপর দুই আইসিসি শিরোপার স্বপ্ন-সমাধি হয়েছে ট্রাভিস হেডের ব্যাটে। এই হেডই যে দুই ফাইনালে ভারতকে তীব্র হেড পেইন দিয়েছে, তা ম্যাচশেষে রোহিত শর্মার কথাতেই বোধগম্য, ‘আমরা দ্রুত উইকেট চেয়েছিলাম। কিন্তু পুরো কৃতিত্ব হেড আর মারনাসের। তারা আমাদের খেলা থেকে পুরোপুরি বাইরে ঠেলে দিয়েছে। তবে সেটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে চাই না। আমরা ভালো বোলিং করিনি। কৃতিত্ব তাদের দুজনের বড় জুটির।’
ট্রাভিস হেড যে শুধু ভারতেরই মাথাব্যথার কারণ হয়েছেন তা নয়। বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ খেলে ৩ ম্যাচেই ম্যাচসেরা হয়েছেন তিনি। প্রত্যাবর্তনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শতক করে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকেও অজিরা হারায় তার অলরাউন্ড নৈপুণ্যে। ব্যাট হাতে ৬২ ও হাত ঘুরিয়ে নেন ২ উইকেট। ফাইনালে রান তাড়ায় দায়িত্বশীল শতকের আগে ফিল্ডিংয়ে বিপরীতমুখী দৌড়ে রোহিত শর্মার ক্যাচ নিয়ে থামিয়ে দেন নীল সমুদ্রের জোয়ার। সেই যে জোয়ার থেমেছিল, পরে আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। হেডের থামিয়ে দেওয়া জোয়ারেই শেষমেশ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় রোহিত শর্মাদের স্বপ্ন।