![এত কাছে, তবু কত দূরে](uploads/2024/06/12/BD-Close-Defeat----Niloy=ok-1718186158.jpg)
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থকদের সয়ে গেছে এসব। এতটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। জেতা ম্যাচ হারতে দেখা কিংবা তীরে এসে ডুবে যাওয়া তরীর অপেক্ষায় থেকে মন ভাঙার গল্প তো এবারই প্রথম নয়। কেশব মহারাজের ফুলটস বলকে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের শট নিশ্চিত ছক্কা ভেবে নেওয়া সমর্থকরা যেন মানতেই পারছেন না সীমানা ছাড়া না হয়ে সেই বলের সমাপ্তি হয়েছে ক্যাচে। আর সেখানেই এপিটাফ হয়ে গেছে বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্ন। এত কাছে থাকা জয় যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেল অনেক দূরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪ রানের পরাজয়ে হতাশামাখা মুখ মনে করিয়ে দেয় ভুলে যেতে চাওয়া পুরোনো অনেক স্মৃতিই। যেই স্মৃতি দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার। সেসব স্মৃতির জন্ম কখনো নিজেদের ভুলে তো আবার কখনো আম্পায়ারের।
নিউইয়র্কের তরতাজা দুঃসহ স্মৃতির জন্ম দুই পক্ষেরই ভুলে। বোলারদের দারুণ শুরুর পর টপ-অর্ডারদের আরেকটি ব্যর্থতায় ভরা দিনে আম্পায়ারও ছেলেখেলা করেছে বাংলাদেশের ভাগ্যের সঙ্গে। দুটো ওয়াইড না পাওয়া, আম্পায়ার্স কলে তাওহিদ হৃদয়ের আউট, লেগ বিফোরের ভুল কল রিভিউতে পাল্টে যাওয়ার পরও বাই ফোর না পাওয়া। সবকিছুই ওলট-পালট করে দিয়েছে বাংলাদেশকে। বিষয়টা এমন নয় যে দাবিটা কেবল সমর্থকদের। বিশ্লেষকরাও সমালোচনা করতে বাধ্য হয়েছেন আম্পায়ার ও নিয়মের।
নিউজিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার সাইমন ডুল ক্রিকবাজের ম্যাচ পরবর্তী শোতে আম্পায়ারিংয়ের সমালোচনা করে বলেন, ‘এই নিয়মটা পরিবর্তন করতে হবে। ধরুন, বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে এই সিদ্ধান্ত গেল। এটা খুবই বাজে সিদ্ধান্ত। ফাইনালে ভাগ্য পুড়তে পারে আম্পায়ারের এমন বাজে সিদ্ধান্তে।’
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রায় আসরেই এমনটা হয়েছে। সবশেষ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপেও। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে লিটনের ২৭ বলে ৬০ রানের বিধ্বংসী ইনিংসেও বাংলাদেশ ব্যর্থ হয় ফিনিশিং টাচ দিতে। অপরিকল্পিত ব্যাটিং এবং সর্বোপরি যথাযথ ম্যাচ পরিকল্পনা সেবার ডুবিয়েছিল বাংলাদেশকে। ওভারপ্রতি সিঙ্গেল ও ডাবল বের করার পাশাপাশি একটা চারের মার অনায়াসেই ম্যাচে বাংলাদেশকে জয়ের স্বাদ দিতে পারত। কিন্তু ব্যাটারদের এই স্বাভাবিক বিচক্ষণতার অভাবে হারতে হয়েছিল। সেদিনও আবার বিরাট কোহলির ফেইক ফিল্ডিং আমলে না নিয়ে বাংলাদেশকে প্রাপ্য ৫ রান থেকে বঞ্চিত করে আম্পায়ার। ম্যাচটাও বাংলাদেশ হেরেছিল ৫ রানেই।
সেই আসরেই পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবকে দেওয়া লেগ বিফোরের সিদ্ধান্ত রিভিউতে দেখা যায় বল আগে সাকিবের ব্যাটে স্পর্শ করেছে, এরপরেও অনফিল্ড আম্পায়ার আদ্রিয়ান হোল্ডস্টকের সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন তৃতীয় আম্পায়ার ল্যাংটন রাসের। সেই ম্যাচ জিতলেই সেমিফাইনালে খেলতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু এক বিশ্বকাপে দুবার আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে সেমিফাইনাল স্বপ্নের বলি হয় বাংলাদেশের।
তার ঠিক আগের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের কাছাকাছি থাকা বাংলাদেশের আরেকটি শেষ ওভারে হার। বোলিংয়ে দুর্দান্ত শুরুর পরও ফিল্ডিং ও ডেথে ব্যর্থতা। এরপরও তাড়া করা সম্ভব এমন লক্ষ্য পেয়েও ব্যাটিংয়ে খেই হারানো বাংলাদেশ শেষমেশ হারে ৩ রানে। লিটন দাস ও অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ম্যাচ শেষ পর্যন্ত টেনে নিলেও, জিততে যখন ৭ বলে ১৩ রান লাগে তখনই লিটনের আউটে কপাল পোড়ে বাংলাদেশের। শেষ বলে ৪ রানের সমীকরণ মেলাতে পারেননি অধিনায়ক রিয়াদ। কাছে চলে আসা ম্যাচটা দূরে চলে যায় বাংলাদেশের ৩ রানের পরাজয়ে। এটাই বোধ হয় স্পোর্টসের বাস্তবতা। ফিনিশিংয়ে খ্যাতিমান মাহমুদউল্লাহ ব্যর্থ হলেন জয় পাইয়ে দিতে।
২০১৬ বিশ্বকাপের বেঙ্গালুরু ম্যাচের ব্যথা এখনো কুরেকুরে খায় সমর্থকদের। ৩ বলে ২ রানের সেই পরাজয়েও জুড়ে আছে রিয়াদের নাম। পরপর দুই বলে ছয় হাঁকাতে গিয়ে মুশফিকুর রহিমের পর রিয়াদেরও উইকেট হারায় বাংলাদেশ। নিশ্চিত জয়ের ম্যাচ অর্থহীন শট খেলে কেবল উইকেট নয়, নিজেদের হাতে থাকা নিশ্চিত জেতা ম্যাচটাই বিলিয়ে দিয়ে আসেন এই দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার। গতকাল নিউইয়র্কে ম্যাচ হারার পর আরেকবার উঠে এসেছে দুই বিশ্বকাপে রিয়াদের ছয় হাঁকাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরিসংখ্যান।
এই তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার প্রথম বড় ঘটনায়ও মাঠে ছিলেন সেই রিয়াদ। ২০১২ এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে ২ রানের হারে মাঠে ছিলেন তিনি। যোগ্য সঙ্গের অভাবে তার দ্বারা সম্ভব হয়নি ম্যাচটি বের করে আনা। চ্যাম্পিয়ন না হতে পেরে মাঠেই কেঁদে দেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, নাসির হোসেনসহ দলের বাকিরাও। জয়ের আভাস পেয়েও সম্ভব হয়নি সেই স্নিগ্ধতাকে আলিঙ্গন করা।
পেসত্রয়ী তানজিম হাসান সাকিব, তাসকিন আহমেদ ও মোস্তাফিজুর রহমানের বিধ্বংসী বোলিংয়ের পরও বাংলাদেশের এমন হারে ব্যর্থতার মূল দায়ভারটা টপ-অর্ডারদেরও বটে। মাঠে টিকে থাকলেই যেখানে জয় পাওয়া সম্ভব, সেখানে সেই টিকে থাকার মেজাজটাই দেখাতে পারেনি গ্যালারিভর্তি বাংলাদেশি দর্শকদের সামনে শান্ত, লিটন, তামিম ও সাকিবরা।
এর মাঝে ম্যাচের মাঝপথে যুক্ত হওয়া আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের দূরত্ব বাড়িয়েছে জয় থেকে। এত কাছে থাকা জয় পরিণত হয়েছে বহু দূরের বস্তুতে। হেরে যাওয়া এই ম্যাচটার হাইলাইটস এখন আউট হওয়ার পর মাথায় হাত দিয়ে পিচের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও ডাগআউটে তাওহিদ হৃদয়ের বিমর্ষ ছবিটাই।