বিপিএলে সর্বাধিক নামে খেলা দুটো দলের একটি গত আসরের রানার্সআপ সিলেট, অন্যটি ঢাকা। এই দুই ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম বদল হয়েছে বারবার। সংখ্যায় ৬ বার। ঢাকার ঝুলিতে তিনবার বিপিএল সেরার সাফল্য ধরা দিলেও, একবারও শিরোপা জিততে পারেনি সিলেট। দুই-একবার ব্যতিক্রম ছাড়া এবারও তাদের অবস্থান শেষর দিকে। সাত দলের মাঝে ছয়। মাত্র এক ম্যাচ জিতে ঢাকা সবার তলানিতে। এবারের আসরে তো মালিক পক্ষের অনুরোধে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার আনফিট হয়েও মাঠে নামা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে সর্বমহলে। সমালোচনায় বাদ যাননি দুই সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল এবং আকরাম খানও। মাশরাফি একাদশে থাকায় তরুণরা বঞ্চিত হওয়া ও বিপিএলের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই দুই অধিনায়ক।
রাজনৈতিক ব্যস্ততায় মাশরাফি এবারের আসর থেকে বিরতি নেওয়ার কিছুদিন পর দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় এই মৌসুমে সিলেটের জার্সিতে আর মাঠে দেখা যাবে না তাকে। কিন্তু মাশরাফি সরলেও ভাগ্য বদল হয়নি সিলেটের। বজায় ছিল অন্যান্য বছরগুলোর মতো হতশ্রী দশা। যেন এক অজানা শেকলে বন্দী সিলেটের ভাগ্য! ১২ ম্যাচে ৫ জয়ে তলানীর দিক থেকে দ্বিতীয় হয়ে থেমেছে যাত্রা !
সদ্যই জাতীয় দলের তিন ফরম্যাটে অধিনায়ক হওয়া নাজমুল হোসেন শান্তও ব্যর্থ হয়েছেন সিলেটের জার্সিতে ভালোকিছু করতে। গেল আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের ব্যাটে ১২ ম্যাচে এসেছে মাত্র ১৭৫ রান। পাননি একটিও অর্ধশতকের দেখা।
গত আসর থেকে সিলেট স্ট্রাইকার্স নামে খেলা দলটি ২০১২ সালে বিপিএলে শুরু করেছিল সিলেট রয়্যালস নামে। যে দলের মালিকানায় ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের নাফিসা কামাল। শুরুর আসরে বিপিএল ভাগ করা হয়েছিল ৬ বিভাগের ৬ দলের সমন্বয়ে। ছিল প্রতিটি দলের একজন করে আইকন ক্রিকেটার। নাফিসা কামালের মালিকানাধীন সিলেটের আইকন ছিলেন অলক কাপালি। যদিও নেতৃত্বের বেলায় রাখা হয়নি তার ওপর আস্থা। অধিনায়কত্ব করেছিলেন ইংলিশ ক্রিকেটার পিটার ট্রেগো। যে আশায় তাকে অধিনায়ক করা হয়েছিল, তিনি পারেননি তা পূরণ করতে। টুর্নামেন্ট শেষ করেছিল তলানির দল হিসেবে। ইমরুল কায়েস, কামরান আকমল, ব্র্যাড হগ ও ড্যারেন সামিদের নিয়ে গড়া দলটি ১০ ম্যাচে জিতেছিল মাত্র ২টি। সেই দুই জয় পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ৮ম ও ৯ম ম্যাচ পর্যন্ত।
পরের আসরে ফ্র্যাঞ্চাইজিটির অধিনায়ক করা হয় মুশফিকুর রহিমকে। তিনি তখন জাতীয় দলেরও অধিনায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বে পাল্টে যায় রয়্যালসদের পারফরম্যান্স। আগের আসরের হতাশা ভুলে দারুণ এক রূপকথার জন্মই দিয়েছিল প্রায়। কোয়ালিফায়ারে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের কাছে মাত্র ৩ রানে হারের পর দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে চট্টগ্রামের কাছে ৩ উইকেটের পরাজয়ে আর সম্ভব হয়নি ফাইনালে পা রাখা। ১৩ ইনিংসে ১৩৩ স্ট্রাইকরেটে ৪৪০ রান করে অধিনায়ক মুশফিক হয়েছিলেন আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
ফিক্সিংকান্ডে মাঝে একবছর বন্ধ ছিল বিপিএল আয়োজন। আগের দুই আসরের সব দলকে বাদ দিয়ে ২০১৫ সালে নতুন উদ্যমে বিপিএল শুরু করে কর্তৃপক্ষ। বিপিএলে নতুনরূপ পেলেও সিলেটের ঘুণে ধরা ভাগ্য আর বদলায়নি। নতুন নাম সিলেট সুপারস্টার্সের হয়ে খেলতে নামা সেই দলের অধিনায়কও ছিলেন মুশফিক। কিন্তু, পুনরাবৃত্তি হয় অনেকটা ২০১২ সালের ফলাফল! ৩ জয়ে তলানির চেয়ে একধাপ ওপরে থেকে পঞ্চম হয় তারা। মাঝপথে শহীদ আফ্রিদিকে অধিনায়ক করেও ঘোরানো যায়নি ভাগ্যের চাকা।
২০১৬ সালের বিপিএলে সিলেট অংশই নেয়নি। ২০১৭ সালে পঞ্চম আসরে তৃতীয়বার পরিচয় বদলায় ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। এবার সিলেট সিক্সার্স নামে আবির্ভূত হয়। ঘরের মাঠে শুরু হওয়া আসরের প্রথম তিন ম্যাচেই জয় পেয়ে নাসির হোসেনের নেতৃত্বে বড়কিছু করার আভাস দিয়েছিল। কিন্তু এরপর হারতে হয় টানা ৬ ম্যাচ। ১২ ম্যাচে সাকুল্যে জয় ছিল ৪টি। ২০১৫ সালের চেয়ে এক জয় বেশি হলেও পয়েন্ট টেবিলে অবস্থানের্ কোনো পরিবর্তনব হয়নি। পঞ্চম স্থানেই ছিল তারা।
ঊনিশের আসরে চমক দেখিয়ে ডেভিড ওয়ার্নারকে দলে নেওয়ার পাশাপাশি করা হয় অধিনায়কও। কিন্তু, তাতেও আলোর মুখ দেখেনি ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যাওয়ার আগে সিলেটের জার্সিতে ৭ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওয়ার্নার। এরপর অধিনায়ক করা হয়েছিল পাকিস্তানের সোহেল তানভীরকে। এবার জয় আসে আগের আসরের তুলনায় একটি বেশি ৫টি। কিন্তু পয়েন্ট টেবিলে অবস্থানের অবনমন ঘটে জায়গা হয়ে ছয়ে।
ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টানো বিপিএলের পরের আসর হয়েছিল মুজিববর্ষের উপলক্ষকে সামনে রেখে। নাম দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু বিপিএল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া সেই আসরটিকে পুরোপুরি ভুলে যেতে চাইবেন সমর্থকরা। একই রকমভাবে ২০২২ সালের আসরটিকেও তারা মনে রাখতে চাইবেনা। দুই আসরে মোসাদ্দেক হোসেন, রবি বোপারার নেতৃত্বেও সিলেট থান্ডার ও সিলেট সানরাইজার্স নামে মাঠে নেমে মাত্র এক জয় নিয়ে পরপর দুবারই থাকতে হয়েছিল তলানিতে।
অবশেষে ২০২৩ সালের আসরে নিজেদের নামের প্রতি কিছুটা সুবিচার করতে পেরেছিল সিলেট। নতুন মালিকানায় নাম হয় সিলেট স্ট্রাইকার্স। মাশরাফির নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ফাইনালে পা রাখে দলটি। বহু বছরের হতাশাকে পেছনে ফেলে নতুন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন সমর্থকরা। কিন্তু ফাইনালে পৌঁছালেও ফাঁকা থেকে যায় ট্রফি কেবিনেট। কুমিল্লাকে ১৭৬ রানের বড় লক্ষ্য ছুঁড়ে দিলেও প্রতিরোধ গড়তে পারেননি মাশরাফিরা। স্ট্রাইকার্সদের ৭ উইকেটের বড় পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ দিয়ে কুমিল্লা জিতে নেয় তাদের চতুর্থ বিপিএল শিরোপা।
অন্যান্য আসরের মতো সিলেট এবারও ব্যর্থ প্লে অফে পা রাখতে। পাঁচটি জয়ে আসর শেষ করা শান্ত-মিঠুনদের অবস্থান সাত দলের মাঝে চয়ে। আবার প্রথম জয়ের স্বাদ পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৬ষ্ঠ ম্যাচ পর্যন্ত। ঠিক কবে নাগাদ সিলেটের নাম বিপিএলের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে কিংবা ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে দেখা যাবে দলটির অধিনায়ককে সেই প্রশ্নই এখন ঘোরপাক খাচ্ছে চতুর্দিকে।