![বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টে রাষ্ট্রদূতের টেলিগ্রাম](uploads/2023/12/15/1702617576.joseph-simpson-farland-3.jpg)
জোসেফ সিম্পসন ফারল্যান্ড ১৯৭১-এর পুরো সময়টাই ইসলামাবাদে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের ৮ থেকে ১৪ তারিখের মধ্যে তার প্রেরিত দুটি টেলিগ্রাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তবতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস থেকে এগুলো তুলে আনা হয়েছে।
১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইসলামাবাদ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গোপন টেলিগ্রাম
প্রাপক: সেক্রেটারি অব স্টেট, ওয়াশিংটন ডিসি
অনুলিপি: মার্কিন কনসাল, ঢাকা; মার্কিন রাষ্ট্রদূত, নয়াদিল্লি, মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি, জাতিসংঘ
বিষয়: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক, ১২ ডিসেম্বর
ক. সকাল সাড়ে ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করি। বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব সুলতান আহমেদ সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্টকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল এবং চাপের মধ্যে রয়েছেন বলে মনে হলো। তবে আমি যেমন আশা করেছিলাম তিনি তার চেয়ে বেশি মনোবল ও সাহস দেখিয়েছেন।
খ. পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের সামরিক পরিস্থিতির সাধারণ আলোচনা নিয়ে আমাদের বৈঠক শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট বললেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিছু হটছে এবং ঢাকার দিকে ফিরছে, এক্ষেত্রে (ভারত) যদি অস্ত্রবিরতিতে সম্মতি না জানায় তাহলে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরক্ষার শেষ চেষ্টা করতে বাধ্য হবে।
গ. তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানে সাধারণ অবস্থা স্থিতিশীল; যদিও কাশ্মীর রণাঙ্গনে সামরিক বাহিনীর সাফল্য অত্যন্ত সীমতি। তিনি আরও বললেন, এয়ারফোর্স ‘চমৎকার কাজ’ করে যাচ্ছে।
অস্ত্রবিরতির বিষয়ে [দুটি টেলিগ্রামের সূত্রে] আমি জানতে চাই জেনারেল ফরমান আলীর অস্ত্রবিরতির প্রস্তাবটিকে গভর্নর মালিকের চিঠিতে বাতিল করা হলো কেন?
[স্টেট ডিপার্টমেন্টের গোপনীয় কাগজপত্র রোয়েদাদ খান সংকলিত ও নির্বাচিত দ্য আমেরিকান পেপার্স-এ টেলিগ্রামটি অসমাপ্ত অবস্থায়ই রয়েছে।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইসলামাবাদ থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গোপন টেলিগ্রাম
সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের উদ্দেশে ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত টেলিগ্রামটি পাঠান। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি দিক-নির্দেশক পত্র।
১. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পতন আসন্ন হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান সরকারের সামনে দুটো পথ- হয় ক্ষতি কমাবে এবং পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিয়ে তাকে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে দেবে অথবা পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রতিকূলতার মধ্যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস শান্তি ও সম্মানের জন্য পাকিস্তান প্রথম পথটি বেছে নেবে। এখন সেখানে জাতিসংঘের ভূমিকা অকার্যকর, কোনো পক্ষকেই কথা না দেওয়া দিয়ে যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ভারতকে প্রভাবিত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা বেশ দেখতে পাচ্ছি- শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়াকে অবসরে যেতে হচ্ছে এবং বর্তমান দ্বন্দ্বের পরিণতিতে প্রকৃত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হচ্ছেন ভুট্টো। শান্তি ফিরে এলে ভুট্টো নিজেকে গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত করতে পারেন। আগামী দিনের পশ্চিম পাকিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা থাকবে অতি সামান্যই আর আমরা মনে করছি পশ্চিম পাকিস্তানিদের চোখে চীন-ই প্রধান মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে।
২. পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে পূর্ব পাকিস্তান এবং সশস্ত্র বাহিনীর এক-চতুর্থাংশ হারানোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছে। ১২ ও ১৩ ডিসেম্বরের বার্তায় পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি ‘মারাত্মক’ বলা হলেও পাকিস্তান সরকার এখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চাইছে না যে তাদের পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বড় মাপের শহর হাতছাড়া হয়েছে। বাস্তবিক কারণেই পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকার বিষয়টি মেনে নিলে পরবর্তী পর্যায়ে এখনকার দ্বন্দ্ব পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হবে।
৩. এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে দূতাবাস (মার্কিন) ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় এনে কয়েকটি প্রাথমিক ভাবনা উপস্থাপন করেছে। যখন যুদ্ধ চলছে এখনকার চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এই ভাবনাগুলো অবশ্যই অনুমান-নির্ভর। ভিন্ন টেলিগ্রামে দূতাবাসের বাংলাদেশ সংক্রান্ত সুপারিশমালা পাঠানো হয়েছে।
আমাদের বিবেচনায় পূর্ব পাকিস্তান হারানোর পর ইয়াহিয়ার সামানে দুটো পথ খোলা:
১) পাকিস্তানের সব সামর্থ্য প্রয়োগ করে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যাতে কাশ্মীরের উল্লেখযোগ্য অংশ দখলে নিয়ে যেতে পারে যা ভারতের সঙ্গে দর কষাকষি করার শক্তি জোগাবে এবং পূর্ব রণাঙ্গনে পরাজয়ের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে কিছুটা সাহায্য করবে। পাকিস্তানের জাতীয় সম্মান ও সেনাবাহিনীর গৌরব পুনরুদ্ধারে এ ধরনের পথ বেছে নেওয়া উত্তম। পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বেকায়দার একটি বিষয় হচ্ছে ভারতের সৈন্যসংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি। এদিকে পূর্ব রণাঙ্গনে শত্রুতার অবসানের সঙ্গে সেখানকার সেনাদল পশ্চিমে এনে ভারত তার সামরিক শক্তি আরও বাড়িয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু এই কর্মকৌশলের ঝুঁকির দিক হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের কাছে উল্টো মার খেয়ে যেতে পারে-, ফলে পশ্চিমে যখন যে সামরিক নেতৃত্ব-বহাল রয়েছে তা ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলবে। আর পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিপর্যয় ঘটলে পশ্চিম পাকিস্তানে নিঃস্ব ও দরিদ্র বনাম ধনাঢ্য শ্রেণির দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে শুরু হবে বালুচ, পশতু এবং এমনকি সিন্ধি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।
২) পূর্ব পাকিস্তান হারানোর ক্ষতি মেনে নেওয়া এবং পশ্চিমে আরও যুদ্ধে না জড়িয়ে তা থামানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই কর্মকৌশল হজম করতে পাকিস্তানের সমস্যা হবে কিন্তু তা আর একবার যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করতে এবং কিছুটা হলেও সেনাবাহিনীর বিশেষ সুযোগ ও মর্যাদা ধরে রাখতে সক্ষম হবে। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ এবং পাকিস্তানিদের নিজেদের প্রোপাগান্ডায় আস্থাশীল হওয়ার কারণে প্রচারণার জোরে পূর্বাঞ্চলে পশ্চিমের গ্লানিকর পরাজয়ের যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবে, তবে লাভের নম্বর যোগ হবে না এর সঙ্গে। গত ক’দিন ধরে পাকিস্তান যেভাবে বলছে যে, মূলত রাশিয়ার সহায়তার কারণেই ভারত সাফল্যের মুখ দেখছে। এই প্রচার দেশের অভ্যন্তরে ধরে রাখতে পারলে কাজে লাগবে।
৩) যদিও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর বাস্তব ও আবেগময় চাপ থাকবে, আমরা মনে করি আরও ক্ষতি এড়াতে এবং লড়াই এড়িয়ে কিছুটা সম্মান ধরে রাখতে যুদ্ধ বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়াই উত্তম। ভারতের মনে কী আছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা কমই। কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কৌশলগত সংশোধনের বিষয়টি ভারতের মনে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যা ইচ্ছে আমরা তাতে আস্থাবান- পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ সীমিত রাখতে হবে, কোনো পক্ষের ভূ-খণ্ড হারানোর বেদনা সইবার আগেই যুদ্ধ শেষ হতে হবে। যেন এর মধ্যে আগামী দিনগুলোতে ভারত পাকিস্তান দ্বন্দ্বের বীজ উপ্ত না হয়।
৪) যদিও এ সময় জাতিসংঘের দ্বারস্ত হলে কার্যকরী কোনো ফল পাওয়া যাবে না, আমাদের বিশ্বাস বাইরের কেউ বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যদি কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে তা ফলপ্রসূ হবে। নীতিগত কারণে উভয় দেশই দ্বন্দ্বে কারও প্রতি কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হওয়ায় মধ্যস্থতা করতে সক্ষম। উভয় দেশের কাছে আমাদের অনুরোধ হতে পারে, তারা যেন উপযুক্ত সময় তাদের ভার ব্যবহার করে ভারত ও পাকিস্তান উভয় বাহিনীর সামনে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরে: কার্যকরী অস্তিত্ব হিসেবে বর্তমান যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ভবিষ্যতে যে নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হবে তা দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের নীতিতে আমূল সংস্কার নিয়ে আসতে পারে- এখনকার বাহিনী ভারতীয় উপনিবেশিক ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি ধ্বংস হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারের টিকে থাকার প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অবলম্বনই ভেঙে পড়বে। তাতে পশ্চিম পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানেও তা ছড়িয়ে গড়তে পারে। যদি শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায় তা হলে আগামীর নেতাদের নীতিমালার লক্ষ্য হয়ে উঠবে প্রতিশোধপরায়ণতা। ভারত তার প্রতিবেশীকে আমাদের চেয়ে ভালো করে চেনে। কিন্তু জয়ের লাগামহীন আনন্দে আগামীতে পাকিস্তানের সঙ্গে সহাবস্থানের সম্পর্ক স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য ভারত বিনষ্ট করতে পারে।
৫) যে পাকিস্তান মার্চের ভুল হিসাব এবং ডিসেম্বরের হঠকারি অভিযানের পর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তাকে আমাদের বলতে হবে ভারতকে পশ্চিমের হাতে তুলে দেওয়া একটি ভ্রান্ত ও অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাজ হয়েছে।
৬) উভয় দেশের আবেগময় সম্পৃক্ততা বিবেচনায় এনে আমরা অন্যদের সঙ্গে কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারব কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সম্ভবত চীন, ইরান এবং বন্ধুভাবাপন্ন আরব দেশগুলোকে এই চর্চায় এগিয়ে আনা যায়।
৭) সীমিত যুদ্ধের পর যদি ধরা হয় সেনাবাহিনীর কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তারা যে ক্লান্ত এতে তো বিতর্ক নেই, আমরা দেখতে পাচ্ছি তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের তিক্ত গালাগালের একটি সময় পার করছি। আমরা মনে করি ইয়াহিয়া ধীরে ধীরে অবসরে চলে যাবেন। সেনাবাহিনী তখন নিজেদের নেতার খোঁজে ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠদের এবং অপর একজন জেনারেল হামিদকে বাদ দেবে। সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা প্রচণ্ড ঘা খেয়েছে এবং শাসনকার্যে তাদের নিজেদের আত্মবিশ্বাসও হ্রাস পেয়েছে। প্রধান দায়িত্ব পালনে সেনাবাহিনীকে ভুট্টোর ওপর ঝুঁকে পড়তে হতে পারে এবং ভুট্টো তা করবেন তার নিজের বেঁধে দেওয়া শর্তসাপেক্ষে আর প্রতীকী পদের চেয়ে তিনি প্রকৃত ক্ষমতার ভাগ চাইবেন। আমাদের বিশ্বাস সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতার একটি বড় ভাগ দেবে।
৮) বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান সরকারকে কথা শোনাবার মতো অসাধারণ সুযোগ রয়েছে। আমরা আশা করব ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তান সরকারের নেতৃবৃন্দ ও ভুট্টোর কাছে প্রবেশধিকার অব্যহত রাখবে- জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অবস্থান এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্টের ভূমিকা এই সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এই প্রবেশাধিকারকে, পাকিস্তান যাকে তার জাতীয় স্বার্থ মনে করেছে তার বিনিময়ে প্রাপ্য মনে করলে চলবে না। বিস্ময়কর ঘোরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের পরাজয় তাদের তাড়া করে ফিরবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে, যেন পশ্চিম পাকিস্তান কোনোদিকে চরমভাবে ঝুঁকে না পড়ে- বামে কিংবা ডানে।
৯) বহু আগে থেকেই পাকিস্তানের যে অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারে হাত দেওয়ার কথা, যুক্তরাষ্ট্র সেদিকটাতে অনেককে সম্মত করাতে পারে। এতে ভারতের প্রতি শত্রুভাবাপন্নতা এবং প্রতিশোধ স্পৃহার অবসান ঘটবে মনে করার কোনো কারণ নেই, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সংঘর্ষ বাধানোর নীতির পরিবর্তন ঘটতে পারে- দেশভাগের পর উপমহাদেশের পাকিস্তানি অ্যাপ্রোচ হিসেবে পরিচিত এ নীতির ফল ভয়াবহই হয়েছে। ভুট্টো এ পথে নিজেকে পরিচালিত করতে পারেন।
১০) সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কের সেতু-পুড়িয়ে ফেলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঢের সমীহ করা হলেও আগামী বছরের জন্য সোভিয়েত ভূমিকা এবং সোভিয়েত প্রভাব খুবই সীমিত হয়ে পড়বে। এখন সম্ভাবনা- সোভিয়েত ইউনিয়ন সোভিয়েতপন্থি বাঙালিদের যেমন মুজাফফর আহমদকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসাতে চেষ্টা করবে। আর তাতে মধ্যবিত্তের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষ হবে। মুজিবের ভাগ্যে যাই ঘটুক বাংলাদেশে প্রত্যাশিত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে শেষ হয় এ সম্পর্কে আগাম কিছু বলা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি সোভিয়েত ইউনিয়ন (এবং ভারত) চীনপন্থি বাঙালি যেমন মোহাম্মদ তোহাকে সামলাতে যেমন চেষ্টা করবে তেমনি বাংলাদেশ সরকারে সোভিয়েতপন্থিদের বসাতেও চেষ্টা করে যাবে।
১১) পশ্চিম পাকিস্তান চীনকে প্রধান মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে যাবে, যদিও সামরিক শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে ব্যর্থতার কারণে চীনকে অনেক কটু-কাটব্যও শুনতে হবে।
আমাদের বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রথম দিককার নৈরাজ্যের মধ্যে চীনারা ভবিষ্যতের চীনপন্থি রাজনীতির/ গেরিলা আন্দোলনের বীজ বপন করবে যাতে সোভিয়েত প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে এবং ভারত বিব্রত হয়। -ফারল্যান্ড
রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের পত্র স্পষ্টভাবেই দেখিয়ে দেয় বাংলাদেশের জন্য মার্কিন জনগণের যত সমর্থনই থাক, মার্কিন সরকার বরাবর পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়াটা ছিল অনিবার্য। সপ্তম নৌবহর নিয়ে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানের পুরনো মানচিত্র অক্ষত রাখার স্বপ্ন যারা দেখেছেন, হতাশ হয়েছেন তাদের সবাই। কার্যত একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ইতোমধ্যেই ‘পরাজিত শক্তি’ ভাবতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়নি। পাশে এগিয়ে আসেনি চীনও।
জোসেফ ফারল্যান্ড-এর জন্ম ১১ আগস্ট ১৯১৪ ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায়, বেড়ে ওঠেন পেনসিলভানিয়ায়, পড়াশোনা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, প্রিন্সটন ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি পেশাগত আইনজীবী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি এফবিআই এবং যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীতে কাজ করেন।
১৯৫৭ সালে তাকে ডমিনিকান রিপাবলিকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে তাকে ১৯৬০ সালে পানামায় রাষ্ট্রদূত করা হয়।
১৯৬৩-তে ওয়াশিংটন ফিরে আসেন এবং পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তাকে আবার কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয় এবং ১৯৭২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় চীন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্থাপনে হেনরি কিসিঞ্জারের বেইজিং (তখনকার পিকিং) সফরের দূতিয়ালি তিনি সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। পরবর্তী দুই বছর ইরানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অতঃপর তাকে নিউজিল্যান্ডে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে কূটনীতি পেশা ছেড়ে পূর্বতন আইন ব্যবসায় ফিরে যান। ২৮ জানুয়ারি ২০০৭ তিনি ভার্জিনিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
[email protected]